03 Oct অন্য ভুবন
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝম। পুরো পৃথিবীতে বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই যেন। অন্ধকার হয়ে এসেছে চারদিকে।
সুমনা ক্যাফের এককোণায় চুপচাপ বসে আছে। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। লোকজন তেমন নেই। মাঝে মাঝে এক ওয়েটার এসে ঘুরপাক খাচ্ছিল। এক কাপ ব্ল্যাক কফির কথা বলল সুমনা। খালি মুখে ক্যাফেতে বসে থাকাটা ভাল দেখায় না। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে সুমনা। দশ বছর হতে চলল, এখনও সেই আগের মতোই চলছে সবকিছু। এর একটা বিহিত না করে আজ যাবে না বলে ঠিক করেছে। দশ বছর অনেক সময়। পরিবারের লোকজন অনেক ধৈর্য্য ধরেছে, তারা এখন একটা পরিণতি দেখতে চায়। পরিণতি সুমনাও চায়। পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকেছে তাও তিন-চার বছর হয়ে গেল। বান্ধবীদের সবার বিয়ে হয়ে গেচ্ছে, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ঘোরাফেরা করে, দেখলে খারাপ লাগে। অফিসের কলিগদের টিপ্পনিও শুনতে হয় মাঝে মাঝে। সজল ছাড়া জীবন চলবে না তা নয়। কিন্তু সজলকে এতো আপন করে নিয়েছে, অন্য কোন ছেলের কথা ভাবলেই মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়।কফি দিয়ে গেছে। এবার ধীরে ধীরে কফিতে চুমুক দিল সুমনা। ঘড়ির দিকে তাকাল। বিকেল পাঁচটা বাজে। কিন্তু আকাশ কালো করে এমন বৃষ্টি নেমেছে যে, মনে হচ্ছে বেশ রাত হয়ে গেছে।
এরমধ্যে বামদিকের কোণার টেবিলের বয়স্ক লোকটা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই গরমের দিনেও লোকটার পরনে ভারি কোট, গলায় মাফলার, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চোখে ভুল দেখছে না সুমনা। লোকটা সত্যি তাকিয়ে আছে, একদৃষ্টিতে। অস্বস্তি কাটানোর জন্য একটু ঘুরে বসল। সজল চলে এলে এসব বিরক্তিকর ব্যাপার ঘটতো না। একা একটা মেয়ে দেখলেই লাইন দিতে ইচ্ছে করে কিছু পুরুষ মানুষের। দরজায় সজলকে দেখা গেল। কাকভেজা ভিজেছে। ওয়েটারদের একজন এগিয়ে গিয়ে একটা তোয়ালে দিল। তাতে মাথাটা কোনরকমে মুছে প্রায় দৌড়ে চলে এলো সজল। মুখটা হাসিহাসি, হাসলে ওর গালে টোল পড়ে। দেখতে খুব ভালো লাগে। এরকম দৌড়ে না এলেও পারতো, আশপাশের লোকজন তাকাচ্ছে। লজ্জা পেল সুমনা। সজল এরকমই। আশপাশে কি হচ্ছে তা ওর চোখে পড়ে না সহজে, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয়।
“স্যরি, অনেক দেরি হয়ে গেল,” চেয়ারে বসতে বসতে বলল সজল।
“কফি দিতে বলবো?”
“বলো, ব্ল্যাক কফি,” সজল বলল, “বৃষ্টি যে এরকম হঠাৎ নামবে কে জানতো।
”“যাক, এবার কাজের কথায় আসি,” সুমনা বলল, আজ আর কোনভাবেই নরম হওয়া যাবে না, “তুমি কী চিন্তা করলে তারপর?”
“কী বিষয়ে?”
“কী বিষয়ে তুমি জানো না?” গলা চড়ে যাচ্ছিল সুমনার, কোনমতে নিজেকে সামলাল।
“বিয়ের কথা বলছো?”উত্তর দিল না সুমনা, কড়া চোখে তাকাল সজলের দিকে।
“বিয়ে তো আমরা করছি-ই, যে কোন দিন যে কোন সময়!” বলে হা হা করে হাসল সজল।
“সেই ‘যে কোন দিন আর যে কোন সময়’ কবে? কবে?”সুমনার দিকে এগিয়ে এলো সজল। মুখ থেকে হাসিটা সরে গেছে। শার্টের পকেট থেকে ছোট একটা প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট বের করে আনল। ভেতরে বেশ কিছু কাগজপত্র দেখা যাচ্ছে। তারমধ্যে থেকে একটা কাগজের টুকরো এগিয়ে দিল সুমনার দিকে।“এটা কী?”“পড়ো।”
ছোট একটা কাগজে পরপর কিছু লাইন লেখা, বিড়বিড় করে লেখাগুলো পড়ল সুমনা, “আমরা ছোট থেকে বড় হই, বড় থেকে বুড়ো, তারপর একসময় মরে যাই। কী অর্থ এই জীবনের? ছোট থেকে বড় হওয়ার পারিপার্শ্বিক প্রক্রিয়া একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম। আমার ক্ষেত্রে সম্পূর্ন ভিন্ন। সেই ভিন্নতাটা এখন টের পাই। যদিও এই ভিন্নতার শুরু হয়েছিল যখন আমার পাড়ায় থাকতে এলো মনজুর রহমানের পরিবার। মনজুর রহমানের মেজো ছেলের নাম সাব্বির। সেই সাব্বিরকে নিয়েই এই কাহিনি শুরু।”
“এসব কী হাবিজাবি লেখা? ঘটনা কী?” জিজ্ঞেস করল সুমনা।
“সাব্বির মনজুরের নাম তোমার মনে নেই?” উল্টো প্রশ্ন করল সজল।
“না, মনে নেই। এটা কি?”
“একটা উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছি। শুরুটা এরকম, ভালো হয়নি?”
“হয়েছে।”“এবার মনে করার চেষ্টা করো।”
“আমি এসব ফালতু ব্যাপার মনে করতে চাচ্ছি না। আমি তোমার কাছে একটা সমাধান চাচ্ছি।”
“তুমি চেষ্টা করলেই মনে পড়বে?”
“ঠিক আছে, চেষ্টা করছি,” হাল ছেড়ে দিয়ে বলল সুমনা।
বাইরে বৃষ্টির তেজ আরো বেড়েছে। জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে দশ বছর আগের এক দুপুরের কথা মনে পড়ে গেল।
***
ভার্সিটির শুরুর দিকে ক্লাসের মাঝখানের ফাঁকা সময়গুলোতে বন্ধুবান্ধবরা যখন ঝাঁক ধরে বসে আড্ডা দেয়, তখন পরষ্পরের সাথে সময় কাটাতেই ভালো লাগতে শুরু করে সজল আর সুমনার। মুখ ফুটে কেউ তখনো বলেনি, কেউ কাউকে ভালোবাসে কি না। কিন্তু কিছু একটা যে ঘটে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে তা টের পায়। এরকম একদিন দুপুর বেলায়, চারপাশ প্রায় ফাঁকা। ক্যান্টিনের এক কোণায় বসে আজকের দিনের মতোই অপেক্ষায় ছিল সুমনা। বাইরে থেকে সজল এলো। অন্যান্য দিনের তুলনায় অনুজ্জ্বল মনে হচ্ছিল ছেলেটাকে।
“সুমনা, অতীতকে বাদ দিয়ে ভবিষ্যত খুবই নড়বড়ে একটা ব্যাপার, তাই না?” চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল সজল। তাকে বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছিল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল সুমনা। সজল কী প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইছে বুঝতে পারছে।
“তুমি কি তোমার আগের কোন রিলেশনের কথা বলবে?”
“তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই?”
“কী জিনিস?”শার্টের পকেট থেকে একটা খাম বের করে আনল সজল, খুব সাবধানে ভেতর থেকে একটা কাগজ বের করল। কাগজটা আর কিছু না। সাদাকালো একটা ছবি। সুমনার হাতে দিল ছবিটা।
“কার ছবি এটা? তোমার?” সুমনা জিজ্ঞেস করে।
“আমি কি এরকম দেখতে ছিলাম নাকি?” সজল বলল, ছবিটার দিকে তাকাল, চৌদ্দ-পনের বছর বয়েসী একটা ছেলের ছবি। সুমনা আর একনজর দেখল ছবিটা। ঈষৎ চাপা নাক, গভীর দুই চোখ আর কোঁকড়া চুলের কিশোর আর যেই হোক, সজল না। সজল দেখতে অনেক হ্যান্ডসাম। তবে এই কিশোরের চেহারার মাধুয্যও আলাদা ধরনের, ঠিক ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়।
“কে এই ছেলে?”
“ওর নাম সাব্বির মনজুর।”
“আচ্ছা।”“আমার পর্দার ওপারের বন্ধু।”
“মানে? খুলে বলো, হেঁয়ালি আমার পছন্দ না।”
“ওর সাথে পরিচয় যখন ওর পরিবার থাকতে এলো আমাদের পাড়ায়। আমাদের বাসার কাছেই ছিল ওদের বাসা। ওর বাবা সরকারি চাকরি করেন। আমার সাথে পরিচিত হলো, কয়েকদিন আমরা একসাথে স্কুলেও গেলাম। কিন্তু কারো সাথে ও কথা বলতো না। আমি ছিলাম ওর একমাত্র বন্ধু।”
“যাক, আমি তো ভেবেছিলাম তুমি বাচ্চাকালের প্রেমকাহিনি শুরু করবে, তারপর কি হল। ”
“আমাকে প্রায়ই বলত, এখানে থাকতে ওর ভালো লাগে না, অন্য কোথাও যেতে চায়। যেখানে সব কিছ অন্যরকম। অন্যরকম একটা যাত্রায় যেতে চায় সাব্বির, যেখানে সামাজিকতা থাকবে না, নশ্বর পৃথিবীর নিয়মকানুন যেখানে অচল।”“তারপর?”“তারপর একদিন সন্ধ্যায় আমি বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, লোকজন তেমন কেউ নেই, শীতের দিন ছিল, আমি দেখলাম সাব্বির একটু দূরের বটগাছটার নীচে দাঁড়িয়ে আছে। হাত নাড়ছে আমার দিকে তাকিয়ে, ডাকছে ইশারায়।”
“তারপর?”
“আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল, আমি দাঁড়িয়ে রইলাম ঠায়, চোখের সামনেই দেখলাম, সাব্বির কেমন যেন ঘোর কুয়াশায় ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।”
“মানে?’
“স্রেফ হারিয়ে গেল। আমার চোখের সামনে থেকে।’
“তারপর?’
“সাব্বিকে এরপর কেউ দেখেনি।”
“ওর বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন?”
“কেউ ওকে খুঁজে পায়নি।”
সুমনা তাকিয়ে রইল সজলের দিকে। এই ছেলেটাকে তার অসম্ভব ভালো লাগে। এরকম একটা গল্প যার জীবনে ঘটে তাকে যেন আরো বেশি ভালোবাসা যায়। কিন্তু এরকম ঘটনা কি সত্যিই ঘটে কখনো?
“আর এই ছবিটা?”“অনেক দিন পর, আমি একটা চিঠি পেলাম। হলুদ খামে। কোথা থেকে এসেছে চিঠিটা জানি না, তবে চিঠির কথাগুলো আমার মনে আছে এখনো।
”“কি লেখা ছিল?”
“মনোযোগ দিয়ে শোন,” বলল সজল, চোখ বুজল, যেন পুরানো সেই চিঠির পাতাটা চোখ বুজে দেখতে পাচ্ছে, “প্রিয় সজল, তোমাকে ডেকেছিলাম। তুমি আসোনি। এই ধরনের যাত্রায় একজন সঙ্গী থাকলে খুব ভাল হয়। দারুণ এক রোমাঞ্চকর যাত্রায় আছি আমি। আত্মিক আর নশ্বর পৃথিবীর মাঝামাঝি এই যাত্রা নিজেকে চেনার জন্য, নিজেকে জানার জন্য। একটা ছবি পাঠালাম, স্মৃতি হিসেবে রেখো। হয়তো জীবনে চলার পথে আবার কোথাও দেখা হয়ে যাবে। ইতি… সাব্বির মনজুর।”
“এই ছবিটাই দিয়েছিল?” জিজ্ঞেস করল সুমনা।মাথা নাড়ল সজল।তারপর সেদিন সাব্বিরকে নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল দুজনের মধ্যে। একজন আরেকজনকে চিনেছিল আরো গভীরভাবে। সেই সন্ধ্যায় কথা দিয়েছিল, অদ্ভুত এই বন্ধুটার কথা জীবনে আর তুলবে না সজল। দশ বছর আগের সেই দিনই সুমনা বুঝেছিল, সজলকে তার চাই। সেই সন্ধ্যায় সজল তার হাত ধরে বলেছিল, সুমনা, আমি তোমাকে ভালোবাসি।অথচ সাব্বির মনজুরের নামটা বেমালুম ভুলে গেছে সুমনা। বর্তমানে ফিরে এলো সুমনা।
***
“তুমি হঠাৎ সাব্বিরকে নিয়ে মেতেছো কেন? এ ব্যাপারে তুমি কথা দিয়েছিলে,” সুমনা বলল।
“দিয়েছিলাম। কিন্ত ইদানীং আবার সব পালটে যেতে শুরু করেছে।”
“কি হয়েছে?”
সজল প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে আনল। বৃষ্টিতে ভেজেনি জিনিসটা। সুমনার হাতে দিল।“ম্যাসেজগুলো পড়ো,” সজল বলল।
সুমনা ম্যাসেজ পড়ল। গত এক সপ্তাহে ‘নো নাম্বার’ লেখা একটা নাম্বার থেকে পাঁচটা মেসেজ এসেছে। ম্যাসেজটা হচ্ছে ‘সাব্বির মনজুরকে মনে পড়ে?’
“এই ম্যাসেজ কে পাঠিয়েছে?”
“জানি না।”
“ট্রাকিং করার ব্যবস্থা করো,” সুমনা বলল, অধৈর্য্যের মতো। আসল প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা হয়েই যাচ্ছে। আসল প্রসঙ্গে ফেরা দরকার।
“সে চেষ্টাও করেছি, কাজ হয়নি।”
“তাহলে আর কি? বাদ দাও,” সুমনা বলল, “এসব নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করে লাভ নেই।”
“বাদ দিতে পারছি না, সুমনা,” সজল বলল, ওর কফিটা দিয়ে গেছে মাত্র ওয়েটার, টেবিলের উপর রাখা প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে আরো কিছু কাগজ বের করে আনল। এরমধ্যে একটা জিনিস সুমনার পরিচিত। সেই দশ বছর আগে দেখা সাদাকালো ছবিটা। ছবিটা কাছে টেনে নিল সুমনা। সাব্বির মনজুর নামক অদ্ভুত সেই কিশোরের ছবি। ঠোঁটের কোনে সূক্ষ্ম হাসির রেখাটা চোখ এড়াল না। দশ বছর আগে যখন ছবিটা দেখেছিল তখন কি এই হাসিটা ছিল? নাকি নতুন যোগ হয়েছে?
এবার পাশাপাশি আরেকটা ছবি এগিয়ে দিল সজল।“এটা গতকাল পেয়েছি, ডাকে,” বলল সজল। ছবিটা হাতে নিয়ে গভীর মনোযোগে তাকিয়ে রইল সুমনা। চারপাশ গাছ-গাছালিতে ঢাকা বিষণ্ণ একটা জায়গা, মাঝখানে কাঠের তৈরি ছোট দোতলা বাড়ি। দোতলার বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে, জোর বৃষ্টি হচ্ছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছে কোন ঘোরের জগতে চলে গেছে সুমনা। বারান্দায় চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছে সে, এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে সজল, ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ছিটে এসে ভিজিয়ে দিলেও তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই সজলের, বরং তা উপভোগ করছে। এক পা এক পা করে সজলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সুমনা, একদম কাছাকাছি গিয়ে সজলের কাঁধে হাত রাখল। ঘুরে তাকিয়েছে সজল। তবে মানুষটা সজল নয়! অন্য কেউ! এই মানুষটা তার পরিচিত নয়, আবার অপরিচিতও নয়। সাব্বির! যুবক সাব্বিরের এরকম চেহারাই হওয়ার কথা। বৃষ্টির ঝাপটা বারান্দার ভেতরে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিল দুজনকেই। সুমনা কথা হারিয়ে ফেলেছে, এবার এক পা এক পা করে পিছু হটছে। সামনে দাঁড়ানো যুবক তার দিকে তাকিয়ে আছে, অবাক দৃষ্টিতে।
সংবিত ফিরতে দেরি হলো না, ক্যাফেতে বসা অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করল সুমনা। হাতে ব্ল্যাক কফির কাপ নিয়ে বসে আছে। আরেক কাপ কফি উল্টোদিকের চেয়ারের সামনে রাখা। সজলকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। প্লাস্টিকের ব্যাগটা পড়ে আছে টেবিলের উপর। তবে কাগজপত্র কিছু নেই, এমনকি ছবিগুলোও। ওয়েটারকে হাত ইশারায় ডাকল সুমনা।
“আমার সাথে যে লোকটা ছিল, তাকে দেখেছেন?” জিজ্ঞেস করল সুমনা।
“উনি তো চলে গেছেন, অনেকক্ষণ হলো।”
“অনেকক্ষণ? কি বলছেন? কতোক্ষণ?”
“ঘন্টাখানেক হবে।”
“ঘন্টাখানেক?” অবাক হলো সুমনা, হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। সাতটার কাছাকাছি বাজে। সজল চলে গেল? এই না একটু আগেই ওর সাথে কথা হচ্ছিল? ছবিটা কোথায়? টেবিলের দিকে তাকাল। কিছু নেই।
“উনি আপনার জন্য এই খামটা রেখে গেছেন,” বলল ওয়েটার, শার্টের পকেট থেকে হলুদ রঙা একটা খাম এগিয়ে দিল সুমনার দিকে।
“ঠিক আছে,” বলল সুমনা, কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল সুমনা, তবে শুনল বিল দেয়া হয়েছে আগেই। কথা বাড়াল না। বাইরে বৃষ্টির তেজ এখন কম, একটা রিক্সা নিলেই হবে। ঘোর অন্ধকারে রিক্সা নিয়ে বাসায় চলে এলো সুমনা। রাগে দুঃখে তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। সজল এরকম কিছু করবে সে কল্পনাও করেনি কখনো। সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অহেতুক এক গল্প ফেঁদেছে সজল। আর কিছু না।রাতে খেল না সুমনা। হলুদ খামটা এখনো ব্যাগে পড়ে আছে। সেই খামে কী আছে ধারনা করতে পারছে। পালিয়ে যাওয়ার অজুহাত দিয়েছে সজল। পড়বে না বলে ঠিক করলেও খামটা খুলল। অদ্ভুত এক সৌরভে ঘরটা ভরে গেল।
“সুমনা, এই মোবাইল আর এসএমএস’এর যুগে তোমাকে আমার প্রথম চিঠি। আমার বন্ধু সাব্বির, যার সাথে খুব অল্প সময়ের পরিচয়, কিন্তু এই অল্পসময়েই আমি জেনেছি, মানবদেহ আর এই নশ্বর পৃথিবীর উর্দ্ধেও এক অদ্ভুত জগত আছে। সে জগতে এতোদিন সাব্বির একাই যাওয়া আসা করতো। আজ থেকে আমি ওর সঙ্গী হলাম। জগতে জ্ঞান আর শান্তিই সবকিছু, সেই জ্ঞান আর শান্তি যদি জাগতিক মোহমায়াকে অতিক্রম করে অর্জন করা যায়, তাহলে তাই হোক। সময়ের বেড়াজালে আটকে থাকি বলে আমরা জানি না, ঠিক কী কারনে কি হয়। আমি সেই বেড়াজাল ভেঙে সময়হীন জগতের বাসিন্দা হতে চলেছি। আমি যাচ্ছি। সরাসরি তোমাকে এই কথাটা বলার সাহস করতে পারিনি। তাই এই চিঠি। আমার গন্তব্য অনেক দূরে কোথাও। কোথায়? তা আমি নিজেও জানি না। তুমি তো ছবিটা দেখেছো? গহীন বনে সুন্দর দোতলা বাড়ি। আপাতত আমার গন্তব্য ঐ বাড়িটা। তারপর অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে। পৃথিবীর উজ্জ্বলতম দিনগুলো তোমার জন্য অপেক্ষা করছে, অপেক্ষা করছে হাসিখুশি মাখা সুন্দর এক ভবিষ্যত। আমি জানি, আমি দেখেছি। তোমার সাথে আবার হয়তো একদিন দেখা হবে, আবার নাও হতে পারে। আমার অপেক্ষায় থেকো না। ভালো থেকো।ইতি, তোমার সজল।”
চিঠিটা পড়তে পড়তে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো সুমনার। ঝাপসা চোখেই দেখল হলুদ কাগজে সজলের হাতের লেখাগুলো কেমন ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। আরো কিছুক্ষণ পর ফাঁকা একটা কাগজ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সুমনা। ক্ষুধা পেয়েছে বেশ। ভেজা চোখে কিছু না লেখা একটা কাগজ নিয়ে ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন বুঝতে পারল না সুমনা। সবাই যে বলে তার মাথা খারাপ, ঠিকই বলে হয়তো। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে গেল।
***
তার পরনে ভারি কোট, গলায় মাফলার, চোখে ভারি কাঁচের চশমা। রাস্তার এক কোণায় ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক মানুষটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, তারপর হাসল। হাসলে তার গালে টোল পড়ে। এই হাসিটা একজনের খুব পছন্দ ছিল। রাস্তায় লোকজন নেই, একটা নেড়ি কুকুর ঘাড় উঁচিয়ে দেখল ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়ানো মানুষটা কিভাবে সোডিয়ামের হলুদ আলোর সাথে মিশে যেতে থাকল। দেখতে দেখতে একদম মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। অন্যান্য দিন হলে চেঁচিয়ে এলাকা গরম করে ফেলত, কিন্তু আজ পেটে দানাপানি কম পড়ায় আর উৎসাহ পেল না। একই ঘটনা নিয়মিত ঘটলে তাতে আর উত্তেজনা থাকে না। ঘাড় গোঁজ করে ঘুমিয়ে পড়ল।
No Comments