25 Jul খাসির পায়া
রফিক সাহেবের একা থাকার অভ্যাস নেই, রাতে একা থাকতে তার ভয় করে, সেই ছোটবেলা থেকেই। এ নিয়ে ঝামেলাও কম হয় না। তাকে একা রেখে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই মালেকার। কাউকে না কাউকে বাসায় এনে রাখতে হয়। বেশিরভাগ সময় রফিক সাহেবের ছোট শ্যালক শামিমকে ডেকে আনা হয়। ভাগ্য ভালো শ্বশুড়বাড়ি কাছাকাছি। যেকোন সময় ডাক দিলেই হয়। এবার শামিমের এইচএসসি পরীক্ষা, সে রাত জেগে পড়ে। বুড়ো দুলাভাইকে পাহারা দেয়ার মতো আগ্রহ তার নেই। তাই অন্তত তিনটা রাত রফিক সাহেবকে একা একা থাকার পরিকল্পনা করতেই হলো।
মালেকাও আর সময় পেল না, পরপর তিন রাতের জন্য ভীতু স্বামীকে রেখে সে তার দুই ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে গেল। হৈ-হল্লা করতে করতে। সাথে গেল ছোট বোন সালেকা, সালেকার স্বামী মজিদ আর দুই ছেলে। কক্সবাজারে এর আগেও অনেকবার গেছে মালেকা। স্কুল-কলেজে পড়া অবস্থায় গেছে, স্বামীর সাথে গেছে কয়েকবার। এবার চাইলে না গেলেও পারতো, কিন্তু সমুদ্রের আহবান এড়ানো নাকি মালেকার পক্ষে সম্ভব না। তাই ছোট বোন আর বোন জামাইয়ের আমন্ত্রনে সাথে সাথে রাজি হয়ে গেছে। এতে যে তার স্বামী পরপর তিনদিন মহা সংকটে রাত কাটাবে সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
‘ভয়কে জয় করো, বয়স তো আর কম হলো না,’ মালেকা বলেছিল ব্যাগ গোছাতে গোছাতে।
‘আমি ভয় পাই কে বলল তোমাকে?’
‘সবাই জানে। পুরুষ মানুষ ভূতের ভয় পেলে চলে?’
রফিক সাহেবের বলতে ইচ্ছে করছিল, আমি কিছুই ভয় পাই না, শুধু ভূত ছাড়া। ছেলে দুটো কাছেই দাঁড়িয়েছিল। ওদের সামনে আর কথা বাড়ালেন না। ওরা এসব শুনলে হাসবে। মালেকা ওদের নিয়ে চলে গেল।
সামনে জুন ক্লোজিং, কাজের ঝামেলা থাকায় রফিক সাহেবের পক্ষে কোনভাবেই ছুটি নেয়া সম্ভব নয়। না হলে যেভাবেই হোক ওদের সাথে রওনা দিতেন। বাধ্য হয়েই তাকে থেকে যেতে হলো।
সকালে বাসা লক করে অফিসে গেলেন। সারাদিন বেশ ভালো কাটল। তিনি সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরলেন না, রমনা পার্কে দীর্ঘক্ষন হাঁটাহাঁটি করার পরিকল্পনা করলেন, যাতে ক্লান্তি চলে আসে। শরীর ক্লান্ত হলে ঘুম চলে আসবে তাড়াতাড়ি।
রমনা পার্কে নানা ধরনের লোকজন হাঁটাচলা করে। এরমধ্যে ভালো মন্দ বোঝা খুব মুশকিল। তবে গত কিছুদিনে চুরি-ছিনতাই এসব কিছু শোনা যায় নি। তিনি অন্ধকার অপছন্দ করেন, কাজেই সেসব জায়গায় হাঁটছিলেন যেখানে আলো আছে। ল্যাম্পপোস্টগুলোর আলোয় হাঁটতে মোটেও ভয় লাগল না। বরং অনেকদিন পর হেটে আরাম পাচ্ছিলেন।
‘একশোটা টেকা দিবেন? মাংস খাইতাম,’ চিকন গলায় পেছন থেকে কেউ বলল।
বিরক্ত হয়ে তাকালেন। একশো টাকা কেউ ভিক্ষা চায়! তাও মাংস খাওয়ার জন্য! অদ্ভুত। কিসের মাংস খেতে চায়!
যে টাকা চাইছে তার দিকে তাকালেন। অল্প বয়েসী একটা ছেলে। উস্কোখুস্কো মাথার চুল, ধুলিধুসর চেহারা, পরনে ছেড়া-ফাটা কাপড়চোপড়।
‘ঐ, যা এখান থেকে।’
‘দেন না, একশো টেকা। খাসির পায়া খামু।’
‘মামা বাড়ির আব্দার! যা তো,’ তিনি তাড়া দিলেন।
ছেলেটা তবু গেল না। তিনি মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। দেখলেন ছেলেটা আশপাশেই আছে। করুন চোখে তাকাচ্ছে। তিনি ঐ করুণ দৃষ্টিকে উপেক্ষা করলেন। পাঁচ-দশটাকা চাইলে দেয়া যেতো। একশো টাকা দেয়া মানে একে প্রশ্রয় দেয়া। ভিক্ষাবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেয়ার পক্ষপাতি তিনি নন। এই বয়সের ছেলে, সহজেই কিছু করে খেতে পারে। তা না করে ভিক্ষায় নেমেছে। আবার খাসির পায়া খাওয়ার সখ! হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন। নয়টার মতো বাজে। খিদে পেয়েছে। বাসায় যাওয়া দরকার। বাসায় ফিরে নিজের জন্য কোনরকম একটা ডিম ভেজে নিলেন, ফ্রিজে ভাত ছিল, গরম করে নিলেন ওভেনে।
হেঁটে ক্লান্ত হলেও ঘুম এলো না। প্রথম রাতটা রফিক সাহেব প্রায় জেগে কাটালেন। রুমের বাতি নেভালেন না, বেডরুমের দেয়ালে ঝুলন্ত টিভিটা চলল সারারাত। ভোর হয়ে এলে জানালা থেকে পর্দাটা সরিয়ে কোনমতে ঘুমালেন ঘন্টাখানেক, তারপর উঠে অফিসে চলে গেলেন। সারাদিন অফিসে কাজ করলেন আর ঝিমালেন।
সন্ধ্যার দিকে আজকেও তিনি বাড়ি ফিরলেন না। তবে রমনা পার্কেও গেলেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘোরাঘুরি করলেন। কোন এক সময় এখানকার ছাত্র ছিলেন। পরিচিত জায়গাগুলোতে অনেকদিন পর ঘোরাঘুরি করে ভালো লাগছিল। রাত আটটার দিকে খিদে পেয়ে গেল। এমনিতে বাসায় তাড়াতাড়ি খাবার অভ্যাস। মালেকা আটটার মধ্যেই ডিনার বেড়ে দেয়।
এখান থেকে শাহবাগ কাছে হবে। কিন্তু অনেকদিন ধরেই পল্টনের দিকে কিছু হোটেল চোখে পড়েছে। ঐদিকে যাওয়া যায়। তিনি রোকেয়া হলের সামনে থেকে একটা রিক্সা নিলেন।
হোটেলটার নাম বিসমিল্লাহ রেস্টুরেন্ট। এই নামে শতশত হোটেল পুরো দেশজুড়ে ছড়িয়ে আছে। তবে এই হোটেলটা নতুন। রান্নার সুনাম করেছিল এক কলিগ। তিনি কালা ভুনা আর সাদা ভাত অর্ডার দিলেন। বাসায় কালা ভুনা চাইলে পাওয়া যাবে না, মালেকা রান্না করতে পারে না।
ওয়েটার ছেলেটা চটপটে। বেশি কথা বলে। এক কালা ভুনার গুনকীর্তণ করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে। চট্রগ্রামের কোন মন্ত্রী নাকি একবার এই কালা ভুনা খেয়ে এমন প্রশংসা করেছে যে আর বলার না। এতোটুকু সময়ের মধ্যে নিজের নাম পরিচয়ও দিয়ে দিল। নাম সোহরাব খান। বাড়ি কিশোরগঞ্জে। সেই কিশোরগঞ্জের বিখ্যাত কয়েকজন ব্যক্তির নামও পটপট করে বলল। তিনি এসবে বিরক্ত হলেন না। কম কথার মানুষ বেশি কথা বলা লোক পছন্দ করে। ছেলেটা কালা ভুনার যেমন প্রশংসা করলো, তাতে বেশ স্বস্তি পেলেন।
আধঘন্টা অপেক্ষা করার পর যা এলো, তাতে মন ভরলো না। কি যেন একটা নেই। কিছু একটা এরা দিতে ভুলে গেছে কালা ভুনায়। সোহরাব খুব আশা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভেবেছিল কিছু বখশিস দেবেন। তবে শুধু বিল মিটিয়ে হোটেল থেকে বেরুতেই দেখলেন ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। এর সাথে রমনায় দেখা হয়েছিল। এখানে কী করছে!
‘মামা, দেন না, একশো টেকা। খাসির পায়া খামু।’
‘তুই আবার আসছিস?’
‘দেন না।’
‘যা তো।’
‘দেন না মামা।’
ছেলেটার ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে প্যান্টের পকেট থেকে একশো টাকার একটা নোট বের করলেন, কিন্তু বাড়িয়ে দিতে গিয়েও দিলেন না। দেখলেন রেস্টুরেন্টের দরজায় সোহরাব দাঁড়িয়ে আছে, বেশ অবাক চোখে দেখছে তাকে। হয়তো ভাবছে তাকে বখশিস না দিয়ে রাস্তার একটা ছেলেকে একশো টাকা দিচ্ছেন। ব্যাপারটা ভালো দেখায় না। তিনি একটা রিক্সা ডাকলেন।
দশটার দিকে বাসায় যখন ঢুকলেন তখন বেশ ক্লান্ত, ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল। বিছানায় শুয়ে টিভিটা ছেড়ে দিয়ে তাকিয়ে রইলেন। বুঝতে পারছেন ঘুম চলে আসবে যে কোন সময়।
ঘুম এলো।
ঘুমের সাথে সাথে খুব স্বাভাবিকভাবেই স্বপ্ন এলো, রফিক সাহেবের ক্ষেত্রে স্বপ্নটা সুস্বপ্ন না হয়ে রীতিমতো দুঃস্বপ্ন হিসেবে এলো।
তিনি দেখলেন তার পায়ের কাছে সেই ছেলেটা বসে আছে। ছেলেটার মুখ কেমন লম্বাটে দেখাচ্ছে। চোখদুটি বড় বড় এবং কালো মনি পুরো চোখ জুড়ে আছে, মাথাভর্তি এলোমেলো চুল। পরনে শুধু একটা হাফ-প্যান্ট। এসব দেখেও হয়তো ভয় পেতেন না তিনি, কিন্তু যখন দেখলেন ছেলেটা তার পায়ের আঙুলগুলো চিবিয়ে খাচ্ছে, তখন আঁতকে না উঠে পারলেন না। ছেলেটার এক হাতে তার ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা শোভা পাচ্ছে।
পায়ের কাছটায় রক্তারক্তি কান্ড হলেও কোনরকম ব্যথা অনুভব করছেন না রফিক সাহেব বরং মনে হচ্ছে ছেলেটা যদি এ কয়েকটা আঙুল খেয়ে শান্তি পায় তো পাক, কোন আপত্তি নেই। কিন্তু ছেলেটার সম্ভবত শুধু পায়ের আঙুলে চলছে না। সে আরো কিছুর আশায় রফিক সাহেবের একেবারে শিয়রের কাছে এসে দাঁড়াল। এবার আর সহ্য করতে পারলেন না রফিক সাহেব। চিৎকার করে উঠলেন।
ঘুম ভেঙ্গে গেল তার। ঘামছেন দরদর করে, রুমের বাতি অফ করে ঘুমান নি, পুরো রুমটা একনজর দেখে নিলেন। সব ঠিকঠাক আছে। কেউ নেই কোথাও। এক গ্লাস পানি খাওয়া দরকার, কিন্তু সেজন্য পাশের রুমে যেতে হবে। আপাতত বিছানা ছাড়ার কোন ইচ্ছেই তার নেই, দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। সবে সাড়ে তিনটা বাজে, রাত পোহানোর অনেক দেরি এখনো। ঘুম আসবে বলেও মনে হচ্ছে না। তিনি টিভির রিমোটটা কাছে টেনে নিলেন। এই সময়ে টিভিই একমাত্র সঙ্গী হতে পারে।
টিভির রিমোট কাজ করছে না, তিনি বিভিন্ন এঙ্গেলে বাটনে চাপ দিচ্ছেন, কাজ হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে বিছানা ছাড়তে হলো। রিমোটটা টিভির একদম সামনে নিয়ে গিয়ে টিপে দিলেন। এবার চালু হলো টিভি। পুরানো দিনের কোন এক বাংলা সিনেমা চলছিল, তিনি চ্যানেল বদলে বিছানার উদ্দেশ্যে পিছু হটলেন।
বুকটা ধ্বক করে উঠল তার।
পা’দুটো কে যেন আটকে ধরে আছে। বিছানার নীচ থেকে কেউ বেরিয়ে এসে তার দুই পা জড়িয়ে ধরেছে। নীচে তাকানোর মতো সাহস পাচ্ছেন না তিনি। হৃদপিন্ডটা গলার কাছে উঠে এসেছে যেন। ভেজা ভেজা একটা হাত তার পায়ের পাতাগুলোর উপর ঘোরাঘুরি করছে। আয়াতুল কুরসী মনে নেই, এমনকি সহজ কোন সুরাও মনে আসছে না।
গলা ফাটিয়ে চিৎকার দেবেন সে শক্তিও পাচ্ছেন না। মনের সব সাহস একসাথে করে তিনি তাকালেন নীচের দিকে। সেই ছেলেটা। দাঁত বের করে হাসছে, ঠোঁটের একপাশে রক্তের দাগ। এক হাতে ডান পায়ের সেই আঙুলটা। এরপর আর কিছু মনে নেই।
চোখ খুলল ভোরের আলোয়। জানালা দিয়ে সূর্য্যের আলোয় চারদিক ঝকঝক করছিল। মেঝেতে শুয়েছিলেন, প্রায় লাফিয়ে উঠলেন তিনি। পায়ের দিকে তাকালেন। বাটা জুতো পরনে। ডান পায়ের জুতোটা খুললেন। যা ভয় পাচ্ছিলেন তা হয় নি। ডান পায়ের বুড়ো আঙুল অক্ষতই আছে এবং জায়গামতো আছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। যাক, খারাপ কিছু হয় নি।
আর মাত্র একটা দিন, কাল সকালেই মালেকা চলে আসবে। তিনি ঘুম ঘুম চেহারায় অফিসে ঢুকলেন। বুঝতে পারছেন, সবাই বেশ অবাক চোখে তাকাচ্ছে। বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে নিশ্চয়ই। কাপড়-চোপড়ের ব্যাপারে খুব সাবধানী তিনি। এক শার্ট টানা দু’দিন পরেন না। সেগুলোও থাকে কড়া ইস্ত্রি করা। আজ সেসবের বালাই নেই।
পিয়ন আমজাদকে ডেকে একটা পান আনালেন। পান খেতে খেতে পুরো ব্যাপারটা ভাবলেন। নাহ! মাথাটা সত্যিই গেছে। দুটো রাত পার করে দিয়েছেন, আজকের রাতটা মাত্র। এই একটা রাতে এমন কি হবে। যা দেখেছেন গত রাতে, এসব তার অবচেতন মনের কারসাজি। মনের মধ্যে ভয় থাকলে এসব হয়, কোথাও যেন পড়েছিলেন।
সবচেয়ে ভালো হয় আজ রাতটা অন্য কোথাও কাটালে। শশুড়বাড়ি কাছেই, কিন্তু বয়স্ক একজন মানুষ ভুতের ভয়ে শ্বশুরবাড়িতে ঘুমাতে যাবে এটা ঠিক মানা যায় না। যাত্রাবাড়ির দিকে একমাত্র ছোট বোন থাকে, অফিস শেষে ওর ওখানে যাওয়া যায়, রাতটা কোনমতে কাটালেই হলো। সকালে তো মালেকা চলেই আসবে।
বিকেল হয়ে গেছে, সাড়ে চারটা বাজে, অফিস শেষ হবে ছয়টার দিকে। বাকি সময়টা কাজে মন দেয়া যাক। পান খাওয়া শেষ করে অফিসের কিছু ফাইলপত্র দেখা শুরু করলেন। দু’একজন কলিগ তার দিকে তাকিয়েছিল। সম্ভবত কথা বলতে চাইছিল। কিন্তু তিনি পাত্তা দিলেন না। অনেকগুলো ফাইল জমে ছিল। আজ সব শেষ করে বের হবেন বলে ঠিক করলেন।
ফাইল দেখতে দেখতে একসময় মনে হলো, অনেক সময় পার হয়ে গেছে। কম্পিউটারের মনিটর থেকে চোখ ফেরাতেও মনে ছিল না। এবার তাকালেন এবং চমকে গেলেন।
পুরো রুম অন্ধকার। শুধু কম্পিউটারের মনিটরের আলোয় কিছুটা আলোকিত হয়ে আছে তার টেবিল সংলগ্ন এলাকা। কারেন্ট চলে গেছে? কারেন্ট চলে গেলে তো জেনারেটর চলবে? আর বাকি সবাই কোথায়? আমজাদ?
হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন। সাড়ে আটটা বাজে! এতো সময় কিভাবে চলে গেল? কেউ তাকে ডাকেও নি যাবার সময়। অদ্ভুত!
নরম গলায় পিয়ন আমজাদকে ডাকলেন কয়েকবার। সাড়া পেলেন না। বাকি সবাই চলে গেলেও এই ছেলেটার যাওয়া নিষেধ, অফিসে একজন লোক থাকলেও তাকে বসে থাকতে হবে। এটাই নিয়ম। কিন্তু সেই আমজাদেরও কোন সাড়া শব্দ নেই।
মোবাইল ফোনটা বের করে কয়েকটা নাম্বারে ডায়াল করলেন, কাজ হচ্ছে না। নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। কম্পিউটারটা অফ করবেন ভাবছিলেন, কিন্তু অফ করলেন না, মনিটরের আলো নিভিয়ে দিলে পুরো রুমটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যাবে। অন্ধকার তার দুচোখের বিষ। তারচেয়ে ধীর পায়ে কোনমতে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।
প্রশ্নটা মাথায় আসে নি, কম্পিউটারটা চালু আছে কিভাবে? বিদ্যুৎ নেই, জেনারেটর চলছে না, কম্পিউটারের ইউপিএসটাও নষ্ট অনেকদিন ধরে। দরজার সামনে যেতে যেতে প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলেন। মনিটরটা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল। পুরো রুমটা অন্ধকার হয়ে এলো। হাতের মোবাইল ফোনটায় চাপ দিলেন, তাতেও কাজ হলো না। মোবাইলে সম্ভবত চার্জ নেই। তাই চলছে না।
ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে রইলেন রফিক সাহেব।
তার মাথার পেছনের চুলগুলো সরসর করে দাঁড়িয়ে গেল যখন টের পেলেন পেছনে কেউ আছে। পেছন ফিরে না তাকিয়েই তিনি বুঝতে পারছেন এই সেই ছেলেটা, কুড়মুড় শব্দ হচ্ছে পেছনে, যেন কিছু একটা কামড়ে খাচ্ছে।
এসব তার অবচেতন মনের কারসাজি, তাকে ভয় দেখাচ্ছে। ভয় পেলে চলবে না। সাহস করে ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। কোথায় যেন পড়েছিলেন ভয় পেলে সেই ভয়ের মোকাবেলা করতে হয়, তাহলেই ভয়কে জয় করা সম্ভব। আজ তিনি ভয়কে মোকাবেলা করবেন। সামনে নিকষ কালো আঁধার, তিনি কিছু দেখতে পেলেন না।
হাঁটতে থাকলেন, দরজার উদ্দ্যেশ্যে। মনে হচ্ছিল জিতে গেছেন তিনি, ভয়কে জয় করে ফেলেছেন। কিন্তু মেঝেতে পড়ে গেলেন হঠাৎ করে, কেউ যেন ধাক্কা দিয়ে তাকে নীচে ফেলে দিয়েছে।
রফিক সাহেব চোখ বুজলেন। চোখ বোজার আগে দেখলেন আবছা একটা ছায়া তার দিকে এগিয়ে আসছে।
‘দুইদিন খাসির পায়া খাইতে চাইছি, দেন নাই,’ কানের কাছে ফিসফিস করে বলল কেউ। অন্ধকারে দেখতে না পেলেও কন্ঠস্বরের মালিক কে তা বুঝতে অসুবিধা হলো না।
‘আমি…আমি…’ তিনি কিছু বলতে গিয়েও পারলেন না, গলায় আটকে যাচ্ছে কথাগুলো। পায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে টের পেলেন, বুঝতে পারছেন, তার পায়ের উপর থেকে প্যান্টটা অল্প অল্প করে উপরে উঠানো হচ্ছে।
‘খাসির পায়ার বদলে মাইনষে পায়া খামু, অসুবিধা কি?’ খ্যাসখ্যাসে কন্ঠস্বর শোনা গেল।
রফিক সাহেব অনুভব করলেন তীক্ষ্ণ কতোগুলো ছুরি বিধে যাচ্ছে তার পায়ে। তিনি চিৎকার করে উঠলেন আতংকে।
আমজাদ ভুলে ছাতা ফেলে গিয়েছিল। অনেকটা দূরে গিয়ে মনে পড়ল। একবার ভাবল বাসায় চলে যাবে, পরক্ষণেই মনে পড়ল বৃষ্টি নামলে এই ছাতাই তার ভরসা। গত কিছুদিন বৃষ্টি হয় নি। কিন্তু হবে না তার গ্যারান্টি কি। সেগুনবাগিচা থেকে অফিস, পুরোটা পথ সে হেঁটেই যায়। বৃষ্টি হলে ভিজতে হবে। বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর নিশ্চিত। আবার এতোটা পথ হেঁটে আবার অফিসে ফিরতেও ইচ্ছে করছে না। এরকম দ্বিধাবিভক্ত মনে বেশ কিছুক্ষন নিজের সাথে আলাপ চালাল আমজাদ। তারপর সিদ্ধান্ত নিলো, ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। ছাতাটা সবসময় হাতের কাছে রাখতে হবে। জ্বর হলে দেখার কেউ নেই।
অফিসের চাবি তার কাছেই থাকে। দ্রুত হেঁটে অফিসে চলে এলো।
অফিসের লক খুলে বাতি জ্বালাতেই অদ্ভুত দৃশ্যটা দেখল। তার রফিক স্যার মেঝেতে পড়ে আছে। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রাণহীন একজন মানুষ। কোমরের নীচ থেকে পায়ের অংশ নেই। মনে হচ্ছে কেউ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মাংস তুলে নিয়েছে। চারপাশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
অফিস থেকে বেরুনোর সময় উনাকে দেখেছিল বলে মনে করতে পারলো না আমজাদ। আশপাশে তাকালো। বুকের মধ্যে কেমন একটা ভয় কাজ করছে। মনে হচ্ছে দ্রুত এখান থেকে বেরুনো দরকার।
দূরে একটা টেবিলের পেছনে খুট করে আওয়াজ হলো। পেছনে হাঁটতে গিয়ে জমাট বাঁধা রক্তে পা পড়ল আমজাদের। হোঁচট খেয়ে মেঝেতে পড়ে যাবার আগে ছেলেটাকে দেখল সে। সারা মুখ রক্তে মাখামাখি অল্পবয়েসি একটা ছেলে চারহাত পায়ে হেঁটে এগিয়ে আসছে তার দিকে। ধীরে ধীরে।
নড়ার শক্তি নেই। মাথার খুলির একপাশ মনে হয় ভেঙে গেছে। এখনো কিছুটা জ্ঞান আছে। তবে সেটা না থাকলেই মনে হয় ভালো হতো। চোখ বুজল আমজাদ। ভাবল, একদিন বৃষ্টিতে ভিজলে কী এমন অসুবিধা হতো!
No Comments