fbpx
 

ছায়া মানব

শরীফুল হাসান

ছায়া মানব

রুমানার একা থাকার অভ্যাস নেই। রাতে একা থাকতে তার ভয় করে, সেই ছোটবেলা থেকেই। এই নিয়ে ঝামেলাও কম হয় নি। স্বামীকে নিয়ে প্রথমবার যখন ঢাকায় এলো, বাপের বাড়ি থেকে সাথে করে ছোট একটা কাজের মেয়ে নিয়ে এসেছিল। সেই মেয়েটা থাকায় রক্ষা। শামীম সকালে অফিসে যায়, রাতে ফেরে। এই এতোটা সময় কাজের মেয়ে জেসমিন সাথে থাকে। ওকে চোখের আড়াল করে না কখনো। শামীম কখনো ঢাকার বাইরে গেলে, জেসমিনকে মেঝেতে বিছানা করে দেয়। এক রুমে একা থাকার যন্ত্রনা থেকে বাঁচা যায় অন্তত।

     এবার শামীম তিনদিনের জন্য সিলেট যাচ্ছে, খবরটা শোনামাত্র জ্বর চলে আসার অবস্থা রুমানার। না গিয়ে কোন উপায় নেই। বৌ একা থাকতে ভয় পায় বলে স্বামী শহরের বাইরে যাচ্ছে না এই ব্যাপারটা ঠিক ভালো শোনায় না।

বহুতল এই বাড়ির এগারোতলার ডান দিকের কোনার ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছে ওরা। শুরুতে এতো উঁচুতে থাকতে রাজি হচ্ছিল না রুমানা, মনে হয়েছিল ভূমিকম্প যদি হয় তাহলে আর রক্ষে নেই। কিন্তু ফ্ল্যাটের বারান্দায় এসে সিদ্ধান্ত বদলাতে এক সেকেন্ডও লাগে নি। এতো চমৎকার বাতাস, মনে হচ্ছিল উড়িয়ে নিয়ে যাবে তাকে। আশপাশে বেশ বাড়িঘর থাকলেও এতো উঁচু কোন আপার্টমেন্ট বিল্ডিং নেই, ফলে চারপাশের বাতাস যেন আলাদা করে ঘিরে রাখে উপরের তলার মানুষগুলোকে।

     মাত্র পনেরোদিন হলো এই ফ্ল্যাটে উঠেছে রুমানা। তারপরও এই পনেরো দিনেই মনে হচ্ছে এরচেয়ে আপন কোন জায়গা তার কখনো ছিল না। ছিমছাম নিরিবিলি। বিরক্ত করার কেউ নেই। পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে না থাকে সে খবর নেয়ারও প্রয়োজন নেই। এমন নয় যে রুমানা অসামাজিক, কিন্তু অচেনা শহরের লোকজনদের সাথে একটু কম কম মেলামেশাই ভালো।

     শামীম সকালে বের হয়ে গেছে, ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে, যাবার আগে হাতে কিছু টাকা দিয়ে গেছে আর বলে গেছে সবসময় মোবাইল ফোনটা যেন হাতের কাছে রাখে, অচেনা কেউ এলে যেন দরজা খুলে না দেয়, এসব সাধারন সাবধানবানী। শামীম চলে যাবার পর সারা সকাল ঘুমিয়ে কাটিয়েছে রুমানা, দুপুরে উঠে কোনমতে একটু খেয়েছে, তারপর আবার ঘুম। সেই ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার একটু আগে। 

     হাত-মুখ ধুয়ে সন্ধ্যার পরপর জেসমিনকে সাথে নিয়ে বসেছিল রুমানা। বারান্দায়। বারান্দাটা বেশ বড়। খোলামেলা, বেডরুমের সাথে একটা স্লাইডিং দরজা দিয়ে আলাদা করা। স্লাইডিং দরজার উপর যে পর্দা থাকে তা গুটিয়ে রাখলে দিনের আলোয় পুরো ফ্ল্যাটটা আলোকিত হয়ে থাকে। আর জোছনা রাতে চাঁদের আলোয় ভেসে যায়।

তবে আজ জোছনা নয়, আজ অমাবশ্যা। আশপাশের বাড়িগুলোর বাতি জ্বলছে, দূর আকাশের তারার মতো। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে জেসমিনকে বলল চুল টেনে দিতে রুমানা। মেয়েটা খুব মনোযোগ দিয়ে চুল টেনে দিচ্ছিল। সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমিয়েও ঘুম যেন কাটে নি, ওর চুল টানায় আবার চোখ বন্ধ করল রুমানা। এতো আরাম লাগছিল ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। একই  সাথে এলোমেলো বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে।

বেশ অনেকক্ষন পর চোখ খুলল রুমানা, মনে হলো মাথায় বিলিকাটা হাত দুতো থেমে গেছে। চুল টানতে টানতে মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়ল নাকি দেখার জন্য তাকাল। চোখ খুলে তাকিয়ে কোথায় আছে বুঝতে একটু সমস্যা হলো রুমানার। বারান্দায় যে চেয়ারে বসেছিল, সে চেয়ারটা একটু বাঁকানো। আরাম করে বসা যায়, হেলান দিয়ে। এখনও একই চেয়ারে বসে আছে সে। তবে সমস্যা হচ্ছে চেয়ারটা এখন আর বারান্দায় নেই। বরং বারান্দার রেলিং পার করে শুন্যে ভাসছে।

বারান্দা থেকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জেসমিন, এতো দূর থেকেও ওর ছলছল চোখ দেখতে পেল রুমানা। শুন্যে ভাসমান চেয়ার থেকে জেসমিনের দিকে হাত বাড়াল। এতে যেন বারান্দা থেকে আরো দূরে সরে গেল রুমানা।

নীচের দিকে তাকাল। অনেক অনেক নীচে রাস্তাটা চোখে পড়ছে, রিক্সা, গাড়ি, বাস চলছে। যেভাবে চলার কথা। আশপাশের বাড়িঘরগুলোর দিকে তাকাল। সবগুলো বাড়ির বাতি জ্বলছে, তবে কেউ এদিকে তাকিয়ে নেই। কারো না কারো চোখে পড়ার কথা।

নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছি আমি, ভাবল রুমানা। দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না। কাজেই ভয়ে কাতর হওয়ার চেয়ে এ অবস্থাটা উপভোগ করা উচিত।

বাতাস পাক খাচ্ছে চারপাশে, হাত দিয়ে বাতাসে একটু ধাক্কা দিতে নিজের ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দার দিকে চলে এলো রুমানা। এই বারান্দাটা অন্ধকার। কেউ নেই বাসায় সম্ভবত। এই ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সাথে পরিচয় আছে, বয়স্কা ভদ্রমহিলা তার অবিবাহিত তরুন ছেলেকে নিয়ে থাকেন, ছেলে সম্ভবত ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, কিসের শিক্ষক কিংবা আরো বিশদ কিছু জানতে চায় নি রুমানা, দরকার কি!

বারান্দা পার হয়ে একটা রুমের জানালার কাছে গিয়ে আটকাল চেয়ারটা। পর্দা সরানো, তাই পুরো ঘরটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দেয়ালে টানানো ঘড়ির দিকে নজর গেল রুমানার। ঘড়ি বলছে রাত দুটো বাজে। অথচ একটু আগেই না সন্ধ্যে হলো! চেয়ারটা হঠাত নড়ে উঠল প্রচন্ড গতিতে, বাতাস ধাক্কা দিচ্ছে, উলটে ফেলতে চাচ্ছে রুমানাকে। চেয়ারের হাতল সবশক্তিতে আটকে ধরে আছে রুমানা। এতো উঁচু থেকে পড়ে গেলে কেউ চিনতেও পারবে না মানুষটা কে ছিল!

রুমের বাসিন্দাকে দেখা যাচ্ছে, এখনো ঘুমায় নি। জানালার ডান দিকে পড়ার টেবিলে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা লিখছে। মাথা নীচু করে লিখছে, খোলা জানালার দিকে তাকালেই অদ্ভুত দৃশ্যটা দেখতে পাবে। তবে এদিকে তাকাবে বলে মনে হচ্ছে না।

দমকা বাতাসে চেয়ারটা দুলে উঠল, জানালার কাছ থেকে সরে গেল অনেকটা। চেঁচিয়ে উঠল রুমানা। চেয়ার সরে যাওয়ার কারনে নয়, ঐ ঘরের মধ্যে সে কিছু একটা দেখেছে, এক পলকের জন্য। কী ছিল সেটা! মানুষ!

‘আম্মাজি, আম্মাজি’ বলে বারান্দা থেকে ডেকে যাচ্ছে জেসমিন, ওর দিকে তাকিয়ে হাসল রুমানা। শুন্যে ভাসমান চেয়ারটা তাকে অনেক দূরে সরিয় নিয়ে যাচ্ছে, অনেক দূরে। সেখান থেকে আর হয়তো ফেরা হবে না।    

***

চোখ খুলে প্রথমেই জেসমিনকে দেখল রুমানা, মাথার চুল টেনে দিতে দিতে মেঝেতে একপাশে কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, বাইরে এখনো ঘনঘোর অন্ধকার, আগে আশপাশের বিল্ডিংগুলোতে বাতি জ্বলছিল, এখন একটাও জ্বলছে না। কলমের দোয়াত থেকে একরাশ কালি যেন কেউ ফেলে দিয়েছে ঢাকা শহরের  আকাশের উপর।

     চেয়ারটা জায়গামতোই আছে, শুন্যে ভাসার ব্যাপারটা আর কিছুই ছিল না, স্বপ্ন কিংবা দুস্বপ্ন ছিল। চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে টের পেল তার শরীর কাজ করছে না। হাতে কোন জোর নেই, একদম অবশ হয়ে আছে, পা দুটো আছে কি নেই সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। স্থির, পুতুলের মতো হয়ে আছে রুমানা। শুধু চোখের মনি দুটো নাড়াতে পারছে নিজের ইচ্ছে মতো, শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে। সম্ভবত একটানা একই অবস্থায় বসে থাকার কারনে পুরো শরীর অবশ হয়ে গেছে, ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে, ধারনা করল রুমানা।

     বেডরুমে খুট করে একটা শব্দ হলো, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাবে সে ক্ষমতাও নেই রুমানার। সম্ভবত পাশের ফ্ল্যাটে একটা বেড়াল থাকে, সেই বেড়ালটা মাঝে মাঝে খাবারের খোঁজে চলে আসে। ওটাই হবে হয়তো।

     তবে তার ধারনা ভুল!

     থপ থপ করে পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কেউ একজন এগিয়ে আসছে। গায়ের রোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল রুমানার। ভয়ে। গলা থেকে কোন শব্দ বেরুচ্ছে না। বিছানার উপর রেখে আসা মোবাইল ফোনটা একটানা বেজেই যাচ্ছে, সম্ভবত শামীম ফোন করেছে। দুশ্চিন্তা করছে নিশ্চয়ই।

     পায়ের শব্দটা কাছাকাছি এসে থেমে গেল।

     দারুন এক উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছিল রুমানা। দরজা লক করা ছিল। যে এসেছে সে লক খুলে এসেছে, চুরি করবে, কিংবা তাকে খুন করবে কিংবা অন্য কিছু…

     ভাবতে পারছিল না রুমানা, তার কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘাম বেয়ে পড়ছে, ধীরে ধীরে।

     গলার কাছাকাছি শীতল একটা স্পর্শ পেল রুমানা। চিৎকার করে উঠল সে, তবে সে চিৎকার কেউ শুনল না।

সকালটা নিজের মতো করে কাটাতে ভালো লাগে আহমেদ করিমের। বেশ কয়েকবছর ধরেই সময় কাটানো আর স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য রমনায় যেতেন জগিং করতে, সেই জগিং করা বেশ কিছুদিন হলো বাদ দিয়েছেন, একা একা দৌড়াবেন, সেখানেও সমস্যা। কিভাবে কিভাবে যেন কিছু লোকজন জুটে গেছে সাথে, দেখা হলেই পিছু ছাড়ে না। কথা বলতেই থাকে। ওরা জানে না, অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষের সঙ্গের মতো বিরক্তিকর কিছু আর নেই।

     অবশ্য কাঙ্ক্ষিত সঙ্গী বলে কোন শব্দ তার অভিধানে নেই। বেশিরভাগ মানুষের প্রতিই তিনি বিরক্ত এবং সে বিরক্তি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

     তবে আজ সকালে সোহেলকে দেখে খারাপ লাগল না। বরং ভাল লাগল। এই একটা ছেলেকেই তিনি কিছুটা হলেও পছন্দ করেন। কেন করেন সেটা তিনি খুঁজে বের করেছেন, খুঁজে বের করতে বেশ কষ্ট হয়েছে।

     চেম্বারে বসে গরম চায়ে পাউরুটি ভিজিয়ে খাচ্ছিলেন তিনি, এ সময় একটু সাবধানে খেতে হয়। চায়ে ডুবানো পাউরুটি একদম নরম থাকে, একটু অসাবধান হলেই শার্ট নোংরা করবে। সেই নোংরা শার্ট আবার নিজেকেই ধুতে হবে। কাজেই খুব সাবধানে তিনি নাস্তাটা সারেন।

     সোহেলকে হাত ইশারায় চেয়ারে বসতে বললেন, সকাল আটটা বেজে চল্লিশ মিনিট। আজ কি সরকারি ছুটির দিন নাকি, ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালেন তিনি।

     “স্যার, আপনার কাছে একটা কাজে এসেছি,” সোহেল বলল।

     “বলে ফেলো,” চায়ের চুমুক দিতে দিতে বললেন আহমেদ করিম, তলানিতে খানিকটা পাউরুটি পড়ে আছে, একদম নরম হয়ে গেছে, আঙুল দিয়ে টেনে বের করে আনলেন পাউরুটির অংশটা, তারপর মুখে পুরে দিলেন।

     “আমাদের বিল্ডিং-এ একটা মেয়ে থাকে, মেয়েটা গত কাল সন্ধ্যা থেকে একধরনের কোমায় আছে।”

     “হাসপাতালে নিয়ে যাও,” আহমেদ করিম বললেন, “এখানে আমাদের কি কাজ?”

     “মেয়েটা হাসপাতালেই,” সোহেল বলল, “একটু আগেই ঢাকা মেডিকেলে রেখে এসেছি।”

     “মেয়ে কি একা থাকে নাকি? তোমার আত্মীয়?”

     “জ্বি, না, স্যার, পাশের ফ্ল্যাটে থাকে,” সোহেল বলল, “ভদ্রমহিলার স্বামী ঢাকার বাইরে।”

     “মেয়েটার যে সমস্যা তুমি জানলে কি করে?”

     “কাজের মেয়েটা ভোরে উঠেই আমাদের দরজা ধাক্কাল,” সোহেল বলল, “আমি তো ভেবেছিলাম মরেই গেছে। পরে শ্বাস-প্রশ্বাস চালু আছে দেখে আর দেরি করি নি। মেয়ের স্বামীকে খবর দেয়া হয়েছে, সন্ধ্যার মধ্যে চলে আসবে। মেয়ের বাবা-মাও ঢাকায় থাকে না, উনারা রওনা দিয়েছে, কখন আসবে কে জানে।”

     “এখানে আমাদের করনীয় কি সোহেল,” চায়ের কাপটা একপাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে বললেন আহমেদ করিম। বিরক্ত লাগছিল তার, ছেলেটাকে সামনে বসিয়ে চা খেলেন, অথচ ওকে সাধা হলো না। সাধতে গেলেই সমস্যা, যদি রাজি হয়ে যায় তাহলে আবার রান্নাঘরে গিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে আসতে হবে। এতো ঝামেলা করার চেয়ে কিছুটা অভদ্র হওয়াও ভালো।

     “এখানে আমাদের কিছু করার নেই, স্যার,” সোহেল বলল, “কিন্তু কাজের মেয়েটা যা বলল তাতে আমি কিছুটা অবাক হয়েছি, সেটা বলতেই আপনার কাছে আসা।”

     “কাজের মেয়ে কি বলল?”

“সে নাকি তার আম্মুজি’কে বাতাসে ভাসতে দেখেছে?”

“আম্মুজি?”

“মেয়েটাকে সে আম্মুজি বলে ডাকে।”

“আচ্ছা, তা কী করতে দেখেছে?”

“বাতাসে ভাসতে দেখেছে,” সোহেল বলল, বেশ কাঁচুমাচু হয়ে, জানে এমন কথা বলছে যা কেউ সহজে বিশ্বাস করবে না। আর আহমেদ করিম তো আরো এক কাঠি উপরে।

“বাতাসে ভাসতে দেখেছে?” নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলেন আহমেদ করিম, “বাতাসে মানুষ কখন ভাসে জানো?”

প্রশ্নটার উত্তর দিল না সোহেল, জানে, এখনই একটু বাঁকা কথা বলবেন আহমেদ করিম।

“মানুষ বাতাসে ভাসবে তখন, যখন তার ওজন হবে বাতাসের চেয়ে কম কিংবা যেখানে কোন মধ্যাকর্ষন শক্তি থাকবে না, তাই না?”

“জ্বি, তাই।”

“তাহলে? পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষন তো একই রকম আছে, আর ভদ্রমহিলাও নিশ্চয়ই বাতাসের চেয়ে হাল্কা নন, কাজেই বাতাসে ভেসে থাকার ব্যাপারটা মিথ্যা।”

“জ্বি।”

“তাহলে এ ব্যাপার নিয়ে এতো চিন্তার কি আছে?”

“জেসমিন যেভাবে বলল তাতে মনে হয় সে সত্যি কথা বলছে।”

“জেসমিন কে?”

“পাশের বাসার কাজের মেয়েটা।”

“আচ্ছা,” চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন আহমেদ করিম, একটা সিগারেট ধরিয়ে পায়চারি করলেন কিছুক্ষন, ঘন ঘন ধোঁয়া ছাড়লেন।

“প্যাঁচটা এখানেই,” আহমেদ করিম বললনে, “তোমার কাছে যেহেতু সত্যি মনে হচ্ছে, তাহলে ব্যাপারটা চিন্তার বিষয়। তারপরও ব্যাপারটা নিয়ে আমরা পরে ভাববো,” সোহেলের কাঁধে হাত রাখলেন তিনি, “তোমার তো খুব আগ্রহ প্যারা-নরমাল ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে, তাই না?”

কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না সোহেল, উনি কোন উত্তর আশা করছেন বুঝতে পারলে সেভাবে উত্তর দেয়া যেত। নার্ভাসভাবে মাথা ঝাঁকাল সে, তাতে হ্যাঁ না কিছুই বোঝা যাওয়ার কথা না।

“গুড,” আহমেদ করিম বললেন, “এসব হাবিজাবিতে বিশ্বাস না রাখাই উত্তম, তারপরও আজ সন্ধ্যায় তোমাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাবো।”

“কোথায়?”

“তুমি ঠিক ছয়টার দিকে চলে এসো, আমি গেটের কাছে থাকবো, ওকে?”

এই ওকে মানে কথাবার্তা শেষ, সোহেলকে চলে যেতে বলা হচ্ছে। মাত্র সকাল ন’টা বাজে। খুব ভোরে উঠে দৌড়াদৌড়ি করে এখন কিছুটা ক্লান্ত লাগছিল। অন্তত আরো কিছুক্ষন ঘুমিয়ে নেয়া দরকার। আজ ইউনিভার্সিটিতেও ক্লাস নিতে যাওয়া হবে না।

আহমেদ করিমকে পায়চারিরত অবস্থায় রেখে নিজেদের বিল্ডিং-এ চলে এলো সোহেল। সন্ধ্যার পর কোথায় যেতে হয় কে জানে?

***

সোহেলের ঘুম ভাঙল বিকেলের দিকে। দুপুরে খাওয়া হয় নি, বলা যায় ক্ষুধার কারনেই ঘুম ভেঙেছে তার। অন্য সময় মা ডেকে দেন, আজ দেন নি কেন কে জানে। বিছানা ছেড়ে সরাসরি ডাইনিং রুমে চলে এলো। টেবিলে ভাত, তরকারি সব সাজানো। পাশের বাসার কাজের মেয়ে জেসমিন একপাশে ঘুমাচ্ছে। দেখে মায়া লাগল।

     খেতে খেতে কলিং বেল বাজল, আশপাশে তাকাল সোহেল। মা সম্ভবত ঘুমাচ্ছেন, বয়স হয়েছে। দুপুরে একটু ঘুম না হলে শরীর খারাপ লাগে।

     কোনমতে হাতটা ধুয়ে দরজা খুলল সোহেল। সামনে দাঁড়ান ভদ্রলোককে চিনতে সমস্যা হচ্ছে না। পাশের ফ্ল্যাটের অধিবাসি। উনার নাম অবশ্য জানা হয় নি, দরকার পড়ে নি।

     “আমি শামীম, রুমানার হাজবেন্ড,” হাত বাড়িয়ে দিল লোকটা।

     “আমি সোহেল, আসুন, ভেতরে আসুন,” বলল সোহেল।

     শামীম ভেতরে ঢুকল, তার হাতে একটা ট্রাভেল ব্যাগ। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

     “জেসমিন তো এখানে? আমি শুধু এই ব্যাগটা রাখবো বলে বাসায় এসেছি,” শামীম বলল, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এতোটা কষ্ট করার জন্য।”

     জেসমিনকে ডেকে তোলা হল, কিন্তু সে কোনমতেই নিজেদের ফ্ল্যাটে যেতে রাজি না। কান্নাকাটি করছিল, ছোট মানুষ, ওকে তাই বেশি জোরাজুরি করল না শামীম। ট্রাভেল ব্যাগটা নিজেদের ফ্ল্যাটে রেখে বের হয়ে গেল। গন্তব্য হাসপাতাল। সোহেল ভাবছিল সাথে যাবে, পরে নিজেকে আটকাল।

সন্ধ্যের দিকে আহমেদ করিমের সাথে তার বাইরে যাবার প্ল্যান আছে। ওটাও খুব গুরুত্বপূর্ন। তবে সন্ধ্যের দিকে বেরুতে পারল না সোহেল। আরেক ঝামেলায় জড়িয়ে গেল।

***

সোহেলের মা সুফিয়া বেগমের বয়স হয়েছে, তিনি বিকেলে ঘুমিয়েছিলেন, সেটাও কিছুক্ষনের জন্য। উঠে চা বানিয়ে খেলেন, পাশের ফ্ল্যাটের কাজের মেয়েটাকে দেখলেন ডাইনিং রুমের মেঝেতে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। তাকে আর ডাকলেন না। সোহেলের এই সময় বাসায় থাকার কথা না।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তিনি সোহেলের রুমে ঢুকলেন। সোহেল ঘুমাচ্ছে। অসময়ে ঘুমাচ্ছে বলে ওকে ধমক দেবেন বলে ঠিক করলেন। বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে ঘরের এক কোনে অদ্ভুত একটা কিছু তার চোখে পড়ল।

চায়ের কাপটা আচমকাই পড়ে গেল হাত থেকে। মাথা টলে উঠেছে। তিনি নিজেও ভারসাম্য রাখতে পারলেন না। হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ে গেলেন। জ্ঞান হারালেন সাথে সাথে।

চায়ের কাপ ভাঙার শব্দে ঘুম ভাঙল সোহেলের। বৃদ্ধা মা’কে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে এগিয়ে গেল। 

     এসব কি হচ্ছে আজ!

     মা’কে বিছানায় তুলে মুখে কয়েকবার পানির ছিটে দিল সোহেল। কাজ হলো।

     সুফিয়া বেগম চোখ খুলে সোহেলকে দেখলেন। তারপর তাকালেন ঘরের কোনার দিকে। হাত ইশারায় সোহেলকে দেখালেন জায়গাটা। সোহেল তাকাল। ফাঁকা জায়গায় আসলে কি দেখাতে চাচ্ছে তা বুঝতে পারছে না।

     “মা, কথা বলো?” সোহেল বলল, “হঠাৎ কি হলো?”

     “কিছু না, বাবা,” সুফিয়া বেগম বললেন, “মনে হলো, ঘরে চোর ঢুকেছে।”

     “আরে না,” সোহেল হেসে উড়িয়ে দিল, “এখানে চোর আসবে কোত্থেকে?”

     “ঐ ছুড়ি ঢুকাতে পারে?”

     “ও তো বাচ্চা মেয়ে, এতো বুদ্ধি ওর নেই,” সোহেল বলল, “তুমি ঠিক আছো তো?”

     “ঠিক আছি, আজ তুই বাইরে যাস নি, আমার কেন জানি ভালো লাগছে না,” সুফিয়া বেগম বললেন।

     মাথা ঝাঁকাল সোহেল। বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ। আহমেদ করিমকে এই কথা জানানোর কোন উপায় নেই। তিনি মোবাইল ফোন ব্যবহার করা বাদ দিয়েছেন। সোহেলের জন্য গেটের সামনে মিনিট দশেক অপেক্ষা করতেও পারেন আবার নাও পারেন।

     জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সোহেল। চারটার দিকে ভাত খেয়ে সে কখন আবার ঘুমাতে চলে এসেছে তা মনে নেই। এতো ঘুম আসছে কোত্থেকে!

     জেসমিন ঘুম থেকে উঠে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে হাত ইশারায় ডাকল সোহেল, মেয়েটা ভীরু ভীরু পায়ে ভেতরে এলো।

     “তুই কি দেখেছিলি সত্যি করে বল তো?”

     “আমি কিছু দেহি নাই,” জেসমিন বলল। ঘাড় কাত করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে, ও যে মিথ্যে কথা বলছে বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না সোহেলের।

     “তখন যে বললি তোর ‘আম্মুজি’ বাতাসে ভাসে?”

     “আমি কিছু দেহি নাই।”

     “আচ্ছা, যা,” সোহেল বলল, “ঘুমা গিয়ে।”

     “আর ঘুমামু না,” জেসমিন বলল, “আমি ঘরে যামু।”

     “কোন ঘরে?” অবাক হলেও কোন ঘরের কথা বলছে মুহূর্তেই বুঝতে পারল সোহেল, “ওরা আসুক, তুই একা একা কি করবি ঐ বাসায়?”

     হেটে আবার ডাইনিং টেবিলের একপাশে গিয়ে বসে  পড়ল জেসমিন।

     মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে বসে রইল সোহেল। একজন ডাক্তার ডাকা দরকার।

আহমেদ করিম ঢাকা শহরের এই দিকটায় আগে কখনো আসেন নি। বুড়িগঙ্গা নদীর ওপাড়ে। টিনের চালা দেয়া সারি করে বানানো একের পর এক ঘর বানানো। এরমধ্যে থেকে সবার শেষ ঘরটায় অবস্থান করছেন তিনি এখন। রাত ন’টার কাছাকাছি বাজে। গত এক ঘন্টায় তিনি একটার পর একটা সিগারেট টেনেছেন। অনেক দিন পর বেশি মাত্রায় টেনশন হচ্ছে, টেনশনের মাত্রা সিগারেটের ধোঁয়ায় আরো বেড়েছে মনে হচ্ছে। রাত ন’টা এখানে নিশুতি রাত, ঝিঁঝিঁ পোকা আর ব্যাঙ মিলেমিশে ডেকে এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করেছে।  

     মেঝেতে পাটি পেড়ে দুজন মানুষ বসে আছে। একজন আহমেদ করিম। দ্বিতীয়জন অল্পবয়স্ক, পরনের জোব্বা ধরনের কাপড়-চোপড়ে ঢাকা মানুষটার বয়স ত্রিশের নীচে। গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা, চিকন টানা ভ্রু, কালো ঘন দাঁড়িতে ঢাকা মুখ-মন্ডল,  চোখে সুরমা দেয়া, আতরের গন্ধে পুরো ঘর আলোড়িত হয়ে আছে। ইসমাইল হোসাইন বাগদাদি নামক এই যুবক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহমেদ করিমের দিকে।

     “আপনি কি বলতে চান পরিষ্কার করে বলেন,” ইসমাইল হোসাইন বাগদাদি বলল, তার চেহারার সাথে কন্ঠস্বর মেলে না। এমন বাজখাই কন্ঠ আশা করেন নি আহমেদ করিম।

     “আমার প্রস্তাব,” গলা পরিষ্কার করে বললেন আহমেদ করিম, “আমি আর আপনি একটা টিম হয়ে কাজ করবো।”

     “টিম? কিসের টিম?”

     “সমস্যার ধরন বুঝে আমি আর আপনি সমাধান দেবো, ব্যাপারটা খুব সিম্পল,” আহমেদ করিম বললেন, “আমার একজন সহকারিও আছে। আপনি আমার সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করলে আমার অনেক সুবিধা।”  

     “আবার বুঝায়ে বলেন। আমি জাগতিক বিষয় একটু কম বুঝি।”

     “আপনাকে তো আমার পরিচয় দিয়েছি, আমি একজন সাইক্রিয়াটিস্ট, বিভিন্ন ধরনের কেস আসে আমার কাছে, আমি সেগুলোর সমাধান করার চেষ্টা করি,” আহমেদ করিম বললেন, “কিন্তু, মাঝে মাঝে এমন কেস আসে যেটা আমার সমাধানের বাইরে।”

     “যেমন?”

     “আমি প্যারানরমাল কাযক্রমে বিশ্বাস করি না। কিন্তু তারপরও মনে হয়…” আচমকা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালেন আহমেদ করিম, “আমার কাঁধে হাত রাখল কে?”

     ঘরে দুজন মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই, ইসমাইল হোসাইন বাগদাদি বিরক্ত মুখে তাকিয়ে আছে আহমেদ করিমের দিকে।

     “আপনের কান্ধে হাত রাখছে আমার প্রিয় শিষ্য আলাউদ্দিন খিজির।”

     “আলাউদ্দিন খিজির কে?”

     “আপনে আমার কাছে আসছেন কি জন্য?”

     “আমার কাছে একটা কেস আছে, আপনার সাহায্য দরকার,” আহমেদ করিম বললেন, আলাউদ্দিন খিজির ‘কে’ এ প্রসঙ্গে যাওয়ার প্রয়োজনবোধ করছেন না আপাতত। ব্যাপারটা সুখকর হবে বলে মনে হচ্ছে না। 

     “কি কেস?”

     “কাল সকালে দেখা হবে, আমার ঠিকানা ঐ খাতায় লিখে দিয়েছি,” বললেন আহমেদ করিম, “তখন বিস্তারিত বলবো।”

     “ঠিক আছে, আপনে এখন আসেন,” বলল ইসমাইল হোসাইন বাগদাদি।

     ঘরের দরজাটা লাগানো ছিল, আহমেদ করিম দরজার কাছাকাছি যাওয়া মাত্র সেটা খুলে গেল। ইসমাইল হোসাইন বাগদাদির দিকে তাকিয়ে নার্ভাসভাবে হাসলেন তিনি। ক্ষনিকের জন্য হলেও ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তবে ব্যাপারটা আসলে ছোটখাট কারসাজি ছাড়া আর কিছুই না। ভন্ড এই লোকটা মানুষকে চমকে দিতে জানে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

     বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা বেজে গেল। সোহেল যে এক মহিলার ভেসে থাকার কথা বলেছে সেটা তিনি একেবারে ফেলে দেন নি, যদিও ওর সামনে সেটা প্রকাশ করেন নি। কাল সকালে সোহেলের সাথে আলাপ করতে হবে। যদি সত্যি প্রয়োজন হয় তাহলে বাগদাদিকে নিয়ে আসতে হবে।

***

মামাতো ভাই মামুন মাত্র ডাক্তারি পাস করেছে, ডাকলেই চলে আসে। অথচ ওর কথাই মনে থাকে না সোহেলের। একটু আগে মামুনকে বিদায়  দিয়ে নিজের রুমে এসে বসেছে। সুফিয়া বেগমকে ঘুম পাড়ানো হয়েছে। জেসমিনকে রান্নাঘরের পাশে ছোট একটা সার্ভেন্টস রুমে ঘুমাতে দেয়া হয়েছে।

নিজের জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে এনে পড়ার টেবিলে বসেছে সোহেল। আজ সারাদিন ভালো ঘুম হয়েছে। এখন সহজে ঘুম আসবে না। তারচেয়ে ইন্টারনেটে কিছু ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে ঘাটাঘাটি করা ভালো। সময় ভালো কাটবে। আহমেদ করিমের সাথে সন্ধ্যার আপয়েন্টমেন্টটা মিস হয়ে গেছে, কাল শুক্রবার, ক্লাস নেই। সকাল সকাল উনার কাছে যেতে হবে।

     সকালে জেসমিনের বলা কথাগুলো বারবার মনে পড়ছে। কী অদ্ভুত কথা! সে তার ‘আম্মুজি’কে ভেসে থাকতে দেখেছে!

     একটা সিগারেট ধরাল সোহেল। সামনে ল্যাপটপটা খোলা থাকলেও লম্বা প্যাডটা টেনে নিল। মাঝে মাঝে কম্পিউটারে না লিখে হাতে লিখতে ইচ্ছে করে। গত কিছুদিন ধরে সে একটা গল্প লেখার চেষ্টা করছে। হচ্ছে না। বলপয়েন্ট পেনটা হাতে নিয়ে আবার রেখে দিল। জানালার কাছে এগিয়ে গেল। বেশ বাতাস আসছে। সিগারেটে টান দিতে দিতে পাশের ফ্ল্যাটের দিকে তাকাল। অন্ধকার একটা জায়গা। রাতে শামীম সাহেব ফেরেন নি, হাসপাতালেই রয়ে গেছেন। তার স্ত্রী’র কী অবস্থা একটা খবর নেয়ার দরকার ছিল। তবে এতো রাতে বিরক্ত করা ঠিক হবে না।

     গল্পটা নিয়ে ভাবছিল সোহেল। একজন বিশিষ্ট বাবুর্চিকে নিয়ে গল্প, যে সব ধরনের রান্নায় দক্ষ। তবে সে বিখ্যাত তার কাচ্চি বিরানির জন্য। একবার এই বাবুর্চি বেশ বড়সড় এক বিয়ের অনুষ্ঠানে রান্নার জন্য ঢাকা থেকে রওনা দেয়। কিন্তু গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর আগেই ঘটে যায় দুর্ঘটনা। কয়েকপাতা লেখা হয়েছে, শেষ অংশটা হাতে এসেও আসছে না। অস্থিরতা পেয়ে বসেছে।

     চেয়ারে গিয়ে বসল সোহেল। লেখা শুরু করল। শুরু করার সময় এক ফাঁকে ঘড়ির দিকে তাকাল। ঠিক একটা বাজে। ঘন্টাখানেক লিখে ঘুমাতে যেতে হবে। বলপয়েন্ট পেনটা তরতর করে চলতে লাগল মসৃন কাগজের উপর।

     প্রায় ঘন্টাখানেক একটানা লেখার পর থামল সোহেল। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, খোলা জানালা দিয়ে বাইরের শীতল বাতাস আসছে, কিন্তু এরমধ্যেও সে ঘেমে গেছে। এতো ঘেমেছে যে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা ঘাম কাগজের উপর পড়ল।

     একদম সোজা হয়ে বসে আছে সোহেল। হাতে বলপয়েন্ট পেনটা ধরা। একটুও নড়ছে না। চোখের কোনা দিয়ে নীচের দিকে তাকাল। নিজের অজান্তেই তার ঘাড়ের চুলগুলো সরসর করে দাঁড়িয়ে গেল। মধ্যবয়স্ক একজন লোক কুঁজো হয়ে বসে আছে। মুখটা ঘষা শ্লেটের মতো ফ্যাকাশে সাদা, বড় চোখ দুটো লাল, ঠোঁটের দুইপাশ ভেজা, লালা কিংবা ঘন কোন তরল পদার্থে। পরনে কোন কাপর-চোপড় নেই। তবে পায়ে একজোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল দেখা যাচ্ছে।

     সোজা সামনের দিকে তাকাল সোহেল। গলা ছেড়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করলেও সারা শরীর অবশ হয়ে আছে। অনুভূতিহীন, বোধবুদ্ধিহীন বলে মনে হচ্ছে নিজেকে। লোকটা এখনও তাকায় নি তার দিকে, বরং সে তার নিজের কাজে ব্যস্ত।

     লোকটা যে কাজে ব্যস্ত, সে কাজটা অদ্ভুত। সোহেলের পায়ের পাতাগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে লোকটা। কড়মড় করে শব্দ হচ্ছে। পায়ে কোন ব্যথা না পেলেও ঘন, ঈষৎ গরম তরল পদার্থের স্পর্শ পাচ্ছে সোহেল। এই তরল পদার্থ আর কিছুই না। রক্ত। গা গুলিয়ে উঠল। এসব কি হচ্ছে ! ভয়ংকর কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে সে। ভয়ংকর! এই দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠতে হবে।

     লোকটা এবার উঠে দাঁড়াল। শুকনো মানুষটা পুরো রুমে পায়চারি করছে, মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে সোহেলের দিকে। নড়ছে না সোহেল, মনে হচ্ছে নড়লেই ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে। তারচেয়ে স্থির হয়ে থাকা ভাল। এই ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন কেটে যাবে। কোন সন্দেহ নেই।

     এভাবে কতোক্ষন বসে আছে মনে নেই সোহেলের। একসময় মনে হলো রুমটা ফাঁকা, কেউ নেই কোথাও। শুকনো লোকটা চলে গেছে, কিভাবে কোথায় গেল মাথায় ঢুকছে না। দুঃস্বপ্নটা কেটেছে বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আরো কিছু ঘটবে। ভয়ংকর কিছু।

     তবে ভয়ংকর কিছু ঘটল না। ভোরের প্রথম আলোয় অনেক দিন পর ঘুম ভাঙল সোহেলের। চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়েছিল রাতে। আড়মোড়া ভেঙে উঠতে গিয়েই ককিয়ে উঠল। পা ব্যথা করছে। রাতে দেখা মধ্যবয়স্ক মানুষটার চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠল। নিজের অজান্তেই চেঁচিয়ে উঠল সোহেল। টেবিলের নীচ থেকে পা জোড়া বের করার সাহস হচ্ছে না। সত্যিই হয়তো দেখা যাবে পায়ের আঙুল একটাও নেই।

     ধীরে ধীরে পা বের করল সোহেল। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে। কিছু হয় নি। পা স্বাভাবিক আছে।

     ভোরের সুন্দর বাতাসে ঘরটা ভরে আছে। মেঝের দিকে চোখ পড়তে আবার কুঁকড়ে গেল সোহেল। একজোড়া ভেজা স্যান্ডেলের ছাপ চলে গেছে বারান্দার দিকে।

     কোনমতে রুম থেকে বেরিয়ে এলো সোহেল। মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে গেল। ছোটবেলায় ভয় পেলে যেমন মা ছিল সব ভরসা, আজ এই সকালে মনে হচ্ছিল মায়ের কাছে গেলেই সব ভয় কেটে যাবে।

     সুফিয়া বেগমের পায়ের কাছে গিয়ে বসল সোহেল। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল, ভয়ের যে অনুভুতিটা একটু আগেও তাড়া করে ফিরছিল সেটা এখন আর নেই।

***

আহমেদ করিমের চেম্বারে নতুন এই লোকটাকে দেখে কিছুটা থতমত খেয়ে গেছে সোহেল। বয়স তার সমান কিংবা কিছুটা ছোটই হবে। তবে ভাবসাব অন্যরকম। মাথাভর্তি লম্বা চুল, বুক পযন্ত দাঁড়ি, প্রশস্ত কপাল, খাড়া নাক, ফর্সা গায়ের রঙ, পরনে সাদা জোব্বা ধরনের পোশাক। সুরমা দেয়া টানা চোখ, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সোহেলের দিকে।

     আহমেদ করিম এই সকাল বেলা একটা বই নিয়ে বসেছেন। সোহেলের সাথে অচেনা লোকটার পরিচয়ও করিয়ে দেন নি। এই অচেনা মানুষের সামনে গতরাতের কথা বলতে অস্বস্তি হচ্ছে।

     “দুঃস্বপ্ন দেখে এতো চিন্তার কী আছে?” বই থেকে মুখ না সরিয়েই বললেন আহমেদ করিম, “তুমি যে এতো ভীতু তা ভাবি নি আগে।”

     “আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না?” সোহেল বলল, তাকে বেশ আহত মনে হচ্ছে।

     “তোমার পায়ের একটা আঙুলও কি খোয়া গেছে? এই ব্যাটা যদি সত্যি সত্যি পায়ের পাতা খেয়ে ফেলত তাহলে এতো সুন্দর জুতো পড়ে এখানে এলে কি ভাবে?”

     “আর কাজের মেয়েটা?”

     “তুমি ওকে নিয়ে এসো, চেম্বারে,” বই রেখে বললেন আহমেদ করিম, “প্রাথমিক টেস্টটা হয়ে যাক।”

     “কিসের প্রাথমিক টেস্ট?”

     “সে তুমি বুঝবে না,” বলে ইশারায় শশ্রুধারীকে দেখালেন আহমেদ করিম।

     নতুন লোকটা এখনো তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সোহেল। কেমন যেন সমস্যা হচ্ছে হাঁটতে, মনে হচ্ছে সত্যি পায়ের পাতাগুলো নেই একটাও, জায়গাটা কেমন খালি খালি লাগছে। পায়ের মাপের চেয়ে বড় জুতো পড়লে যেমন অনুভূতি হয়, তেমন লাগছে।

জেসমিনকে নিয়ে নীচে নামতে খুব বেশিক্ষন লাগল না। বাধ্য মেয়ের মতো সোহেলের সাথে এলো মেয়েটা। ওকে নিয়ে সোজা আহমেদ করিমের চেম্বারে ঢুকে পড়ল সোহেল।

জেসমিনকে একটা চেয়ারে বসাল সোহেল। আহমেদ করিম তার হাতের বইটা রেখে সোজা হয়ে বসেছেন। তাকিয়ে আছেন জেসমিনের দিকে।

“আমারে এইখানে নিয়া আসছেন ক্যান?” জিজ্ঞেস করল জেসমিন।

“তোমার বয়স কতো?” আহমেদ করিম জিজ্ঞেস করলেন।

“এগারো,” এক কথায় উত্তর দিল জেসমিন।

“বাবা-মা কি করে?”

“মা মরছে, বাবা বাইচা আছে,” জেসমিন বলল।

“সে কি করে?”

“কিছু করে না।”

“নিন, এবার আপনার পালা,” তরুন শশ্রুধারীর উদ্দেশ্যে বললেন আহমেদ করিম, “সোহেল, তোমার সাথে পরিচয় করানো হয় নি, উনি ইসমাইল হোসাইন বাগদাদি।”

তরুনের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল সোহেল। পিচ্চি একটা ছেলের নামের বাহার দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু কিছু বলা যাবে না।

“মা জেসমিন, তুমি তোমার আম্মুজিকে বাতাসে ভাসতে দেখছো?” এবার জিজ্ঞস করল ইসমাইল হোসাইন বাগদাদি।

“জ্বি, দেখছি।”

“বাতাসে ভেসে সে কোথায় যাচ্ছিল?”

“উনাদের বাসায়,” সোহেলকে দেখিয়ে বলল জেসমিন।

“তারপর?”

“তারপর আমার মনে নাই,” জেসমিন বলল।

“তোমার কি ঢাকা থাকতে ভালো লাগে?”

“না, ভালো লাগে না।”

“তুমি কতোদিন উনাদের সাথে?”

“ছয়মাস,” জেসমিন বলল।

“তার আগে?” ইসমাইল হোসাইন বাগদাদি বলল।

“এতিমখানায় ছিলাম, আমারে তাড়াইয়া দিল,” জেসমিন বলল।

“এতিমখানা থেকে তাড়িয়ে দিল? কোন এতিমখানা ছিল?”

“ময়মনসিং সরকারি এতিমখানা,” জেসমিন বলল, “আমার বাবা আমারে দেখতে আসল, তারপরই আমারে তাড়াইয়া দিল।”

“তারপর কি হলো?”

“আমার বাপে আমারে রেলস্টেশন ফালাইয়া ভাগল,” জেসমিন বলল, “আমার আম্মুজি আমারে পাইলেন সেখানে, তারপর থেইক্যা উনার সাথে।”

“তোমার বাবা তোমাকে রেখে ভাগল?”

“জ্বি,” জেসমিন বলল।

“এখন সে কোথায়?”

“ঢাকায় আসছে,” জেসমিন বলল, “আমারে নিতে।”

“ক্যান, এইখানে তো তুমি ভালই আছো?”

“জ্বি,” জেসমিন বলল।

কথাবার্তার এই পযায়ে ইসমাইল হোসাইন বাগদাদি আহমেদ করিমের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল।

“সোহেল, জেসমিনকে চেম্বারের বাইরে রেখে এসো,” আহমেদ করিম বললেন, “একটু কথা আছে।”

জেসমিনকে বাইরের উঠোনের এক কোনে দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরে ঢুকল সোহেল।

“সোহেল,” বেশ গম্ভীরভাবে বললেন আহমেদ করিম, “তুমি ময়মনসিংহ সরকারি এতিমখানায় এ মেয়েটাকে নিয়ে খবর নাও। ওদের কাছে রেকর্ড থাকার কথা। গত একবছর আগে এরকম কিছু ঘটেছে কি না। আপনি কি বলেন বাগদাদি সাহেব?”

বিড়বিড় করে কিছু একটা পড়ছিল ইসমাইল হোসাইন বাগদাদি। তার হাতে ছোট ছোট দুটো তাবিজ দেখা গেল।

“আপনি এই তাবিজটা মেয়েটার গলায় পড়িয়ে দেবেন,” বাগদাদি বলল, “আর আপনি নিজেও একটা পড়বেন, ওজু করে। ঠিক আছে?”

“আমি তাবিজ পড়ি নি কখনো?” সোহেল বলল, “আপনি কি বলেন?” আহমেদ করিমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

“সোহেল, সত্যি কথা বলতে, আমি আর বাগদাদি সাহেব একটা টিম করেছি, তুমিও এই টিমে আছো, সহকারি হিসেবে,” গলা পরিষ্কার করে বললেন আহমেদ করিম, “আর মনে হচ্ছে আমাদের এই টিমের প্রথম কেস হচ্ছো তুমি?”

“আমি?”

“হু,” আহমেদ করিম বললেন, “তুমি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখা শুরু করেছো, তোমার প্রতিবেশি কাজের মেয়ে মানুষকে ভেসে থাকতে দেখছে। ব্যাপারগুলো ঠিক স্বাভাবিক না। তাই না?”

“জ্বি।”

“কাজেই তোমার উচিত, আমাদের কাজে সহযোগিতা করা, তাই না?”

“জ্বি।”

“প্রথম কেস, সেটাও তোমার, কাজেই এই কেসে আর্থিক কোন লেনদেনে যাবো না আমরা।”

“আচ্ছা,” বলল সোহেল। দারুন অস্বস্তি লাগছিল, রাগও হচ্ছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল বলতে, আর্থিক লেনদেনে কোন আপত্তি নেই, কতো টাকা দিতে হবে। কিন্তু নিজেকে কোনমতে সামলাল।

“তুমি তাবিজটা পড়বে, এই মেয়েটাকেও পড়াবে, কাল সকালে আমরা আবার একসাথে হচ্ছি, ওকে?”

উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে এলো সোহেল। তার হাতে দুটো তাবিজ। শার্টের পকেটে খুব সাবধানে রাখল তাবিজদুটো।

     জেসমিনকে নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে চলে এলো। মেয়েটার গলায় তাবিজটা ঝুলিয়ে দিয়েছে এরমধ্যে। নিজের তাবিজটা টেবিলের একপাশে রাখল। জুম্মার নামাজের সময় হয়ে গেছে। জেসমিনকে মায়ের কাছে রেখে বেরিয়ে এলো সোহেল। নীচে এসে শামীম সাহেবের সাথে দেখা হলো। ভদ্রলোককে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। সাথে বয়স্ক দুজন মানুষ। না বললেও বুঝতে অসুবিধা হলো না এঁরা শামীমের শ্বশুর-শ্বাশুড়ি।

     ইচ্ছে থাকলেও এগিয়ে গিয়ে কথা বলল না সোহেল। আজ কিছু ভালো লাগছে না।

দুপুরের পরপর বাসায় ফিরে জেসমিনকে পাশের ফ্ল্যাটে দিয়ে আসল সোহেল। বাড়ির লোকজন চলে এসেছে, এখন আর মেয়েটাকে নিজের বাসায় রাখার কোন মানে নেই। মা’র পাশে বসে কিছুক্ষন গল্প করল। বিকেলের দিকে একবার ভাবল আহমেদ করিমের চেম্বারে যাবে। কিন্তু পরে চিন্তাটা বাদ দিল। উনি স্বার্থপর ধরনের, টাকা-পয়সা ছাড়া কিছু বোঝেন না, এখন আবার টিম বানাচ্ছেন ! ভাবতেই রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল সোহেলের।

     কিন্তু নীচে নেমেই ভদ্রলোকের সাথে দেখা হয়ে গেল। আহমেদ করিম গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। একমনে কিছু একটা বলছেন। এগিয়ে গেল সোহেল।

     “এখানে কি করছেন?” জিজ্ঞেস করল সোহেল।

     “আমার ইনটুশইন বলছিল, তুমি নীচে নামবে, তোমার সাথে আমার দেখা হবে,” বলে একটু হাসলেন আহমেদ করিম, “মোবাইল ফোন তো নেই, যে কল করে ডাকব।”

     “সেজন্য কি মনে মনে ডাকছিলেন?” একটু বাঁকা করে বলল সোহেল।

     “তুমি মনে হয় আমার কথায় মাইন্ড করেছো,” আহমেদ করিম বললেন, “আসলে আমি অতিমাত্রায় অসামাজিক প্রানী। কারো মন রেখে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটা মাঝে মাঝেই আমার মনে থাকে না। তবে, সোহেল,” বলে সোহেলের কাঁধে হাত রাখলেন তিনি, “তোমাকে কিন্তু আমি ভালোই পছন্দ করি।”

     উত্তরে কিছু বলল না সোহেল। লক্ষ্য করল, তার রাগ কিছুটা পড়ে আসছে। বয়স্ক একজন মানুষ এভাবে বললে তার উপর রাগ করে থাকা যায় না।

     “ঐ ইসমাইল হোসাইন বাগদাদি’কেও আমার পছন্দ হয়েছে,” আহমেদ করিম বললেন, “তা তোমার গলায় তাবিজ নেই কেন?”

     “আপনি তাবিজ-কবজে বিশ্বাস করেন?”

     “তোমাকে পড়তে বলা হয়েছে, তুমি পড়বে,” আহমেদ করিম বললেন, “বিশ্বাস অবিশ্বাস জানি না। তোমার দুঃস্বপ্ন কিংবা জেসমিনের ঘটনাটার সাইকোলজিক্যালি ব্যাখ্যা হয়তো আমি দিতে পারবো, কিন্তু সেটা আমার কাছেই অনেক গোলমেলে মনে হচ্ছিল। তাই অন্য পথ ধরেছি। এ ক্ষেত্রে বাগদাদি’ই আমাকে সাহায্য করতে পারে।”

     “দেখা যাক,” সোহেল বলল, “আমি তাবিজ পড়বো।”

     “আমি হাঁটতে বেরুবো, তুমি আসবে আমার সাথে?” জিজ্ঞেস করলেন আহমেদ করিম।

     এই সময় দূরে ইসমাইল হোসাইন বাগদাদি’কে আসতে দেখল সোহেল।

     “আমি যাই, আপনার হাঁটার সঙ্গী চলে এসেছে,” বলে নিজেদের আপার্টমেন্টের গেট দিয়ে ঢুকে পড়ল সোহেল।

সন্ধ্যার পরপর বাসায় ফিরে এসেছে সোহেল। আহমেদ করিম আর বাগদাদি’র সঙ্গ খারাপ লাগছিল না। ওরা হাঁটতে হাঁটতে রমনা পার্কের দিকে গেল। দুজন নিজেদের মধ্যে গল্পে এমন মশগুল যে নিজেকে বাড়তি মনে হচ্ছিল।

     বাসায় এসে তেমন কাজ ছিল না। টিভি দেখে, খেয়ে দেয়ে নিজের রুমের চেয়ারে আরাম করে হেলান দিয়ে বসতেই চোখ লেগে এলো। দেয়াল ঘড়িতে তখন মাত্র দশটা বাজে। এতো তাড়াতাড়ি কখনো ঘুমায় না সে। তারপরও শরীর কেমন খারাপ লাগছিল। ভাবল আধঘন্টার ছোট একটা ঘুম দিয়ে জেগে উঠবে।

     কিছুক্ষন পরেই নিজেকে অদ্ভুত এক অবস্থায় আবিষ্কার করল সোহেল। তার গায়ের সব লোম দাঁড়িয়ে গেছে মুহূর্তেই। সেই মধ্যবয়স্ক মানুষটা। পায়ের কাছে উবু হয়ে বসে আছে। তার পায়ের আঙুল খাচ্ছে কামড়িয়ে। চিৎকার দিতে গিয়েও শব্দগুলো ঘোৎ করে গিলে ফেলল সোহেল। মনে হচ্ছিল কোন শব্দ করা যাবে না। হঠাৎ মনে হলো মাথার চুল হাতিয়ে দিচ্ছে কেউ, পিঠের উপর ধাক্কা দিচ্ছে আলতো করে।

     আমি ভুল দেখছি, ভুল শুনছি, মনে মনে বলল সোহেল। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলছে সে।

     “অ্যাই, তোর ঘুম ভাঙে না কেন, সোহেল, উঠ,” পিঠে সুফিয়া বেগমের ধাক্কাটা এবার অনুভব করল সোহেল।

     চোখ খুলে ধড়মড় করে বসল।

     সব ঠিক আছে। তার বৃদ্ধা মা পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ।

     “এরকম বসে বসে কেউ ঘুমায়? হ্যাঁ?” সুফিয়া বেগম বললেন, “দ্যাখ, তোর সাথে দেখা করতে কে কে এসেছে?”

     দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল সোহেল। দশটা দশ বাজে। এই রাতে কে আসবে তার কাছে? 

     দরজা খুলে অবাক হলো সোহেল। আহমেদ করিম আর বাগদাদি দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের চেহারা গম্ভীর।

     ড্রইং রুমে বসাল দুজনকে। মা সুফিয়া বেগমকে ভেতরের রুমে পাঠাল।

     “আপনারা এই সময়?” সোফায় বসতে বসতে বলল সোহেল।

     “বাগদাদি সাহেব বললেন, তোমার ব্যাপারটা নিয়ে হেলাফেলা করা ঠিক হবে না,” আহমেদ করিম বললেন, “তার ধারনা, এইখানে…”

     “আপনার উপর জ্বিনের আছর হয়েছে,” থমথমে গলায় বলল বাগদাদি। তাকে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল। সোফায় বসতে গিয়েও বসেনি। ঘরটা দেখছে। পযবেক্ষনের দৃষ্টিতে।

     “আমার উপর! কি যে বলেন!” সোহেল বলল। বাগদাদি’র মাথা যে ঠিক নেই এই কথাটা প্রথমবারের মতো তার মাথায় উঁকি দিল।

     “আমি আপনার রুমটা দেখতে চাই,” বাগদাদি বলল।

     “চলেন,” বলল সোহেল।

     হেঁটে নিজের ঘরে ঢুকল সোহেল। পেছন পেছন আহমেদ করিম আর বাগদাদি। ছোট রুমটা এখন প্রায় অন্ধকার। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। একপাশে খাট, বই রাখার শেলফ আর আলমিরা, এই সামান্য আসবাব। টেবিলের উপর ল্যাপটপটা খোলা।

     রুমে ঢুকেই নাকে হাত দিল বাগদাদি। তার দিকে অবাক হয়ে তাকাল সোহেল, আহমেদ করিমও অবাক হয়েছেন। তবে প্রকাশ করলেন না।

     “এতো বাজে গন্ধ কিসের?” বাগদাদি বলল।

     “কোথায় গন্ধ?”

     “এই রুমে আর এক সেকেন্ডও থাকা যাবে না, বেরিয়ে আসুন,” বলল বাগদাদি, তারপর প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। ডাইনিং রুমে গিয়ে দাঁড়াল। দৌড় দেয়ার কি আছে বুঝতে পারল না সোহেল। তবে আহমেদ করিমের সাথে সাথে সেও বেরিয়ে এলো।

     “দেখেন, আমার হাতের সব লোম দাঁড়িয়ে গেছে,” বলে নিজের হাত দেখাল বাগদাদি, কাছ থেকে দেখলেন আহমেদ করিম।

     “সত্যিই তো,” আহমেদ করিম বললেন, “কিন্তু আপনি এতো ভয় পেলেন কেন?”

     “এর উত্তর এখানে নেই,” বাগদাদি বলল, “কাজের মেয়েটা কোথায়?”

     “পাশের ফ্ল্যাটে,” সোহেল বলল।

     “সেখানে নিয়ে চলেন,” বাগদাদি বলল।

     “এতো রাতে সেখানে যাওয়া ঠিক হবে না,” সোহেল বলল, বেশ অস্বস্তি লাগছিল তার।

     “ভাই, দেরি করবেন না, এক্ষুনি চলেন,” বাগদাদি বলল।

     আহমেদ করিমের দিকে তাকাল সোহেল। তিনি চোখ দিয়ে হ্যা-সূচক ইশারা করলেন। এরপর মানা করার কিছু নেই।

     দরজা বন্ধ করে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলো সোহেল।

     পাশের ফ্ল্যাটে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নক করতে অস্বস্তি লাগছে। এতো রাতে অচেনা দুজন মানুষকে নিয়ে দাঁড়ালে ভদ্রলোক কি মনে করবে কে জানে।

     কিন্তু উপায় নেই নক না করে। আহমেদ করিম আর বাগদাদি দুজনেই তাকিয়ে আছে তার দিকে। অস্বস্তি লাগলেও দরজায় নক করল সোহেল। অবাক হলো, নক করার সাথে সাথে দরজা খুলে গেছে।

     এরকম হবার কথা নয়। এটা ঢাকা শহর। এখানে কেউ বাসার দরজা খোলা রাখে না। ভেতরে বাতি জ্বলছে না। অন্ধকার। শামীম সাহেবের শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি এসেছেন, তারা কোথায়? শামীম সাহেব? কিংবা কাজের মেয়ে জেসমিন? সবাই কি হাসপাতালে গেছে রুমানাকে দেখতে? যাওয়ার সময় দরজা লক করতে ভুলে গেছে? অনেকগুলো প্রশ্ন। উত্তর দেয়ার কেউ নেই আপাতত।

     সোহেল ভেতরে ঢুকতে ইতস্তত করছিল দেখে বাগদাদি এগিয়ে গেল। একমনে কিছু একটা পড়ছে আর বুকে ফুঁ দিচ্ছে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা লাইটার বের করে লাইটারটা জ্বালাল।

     বাগদাদি’র পেছন পেছন রুমে ঢুকলেন আহমেদ করিম। তাকে খুব উৎসাহী মনে হচ্ছে। সোহেল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষন। ফাঁকা করিডোরটাকে বেশি ভয়ানক লাগা শুরু হতেই আহমেদ করিমের পেছনে চলে এলো সে।

     লাইটারের অল্প আলোয় পুরো ঘরটা দেখা যাচ্ছে না। তবে বোঝা যাচ্ছে এটা ড্রইং রুম। দুইপাশে বেতের সোফা সাজানো। মেঝেতে পাতলা কার্পেট। আহমেদ করিম কিছু বলতে যাবেন তাকে হাত ইশারায় চুপ থাকতে বলল বাগদাদি।

     ড্রইং রুমের পর খানিকটা ফাঁকা জায়গায় ডাইনিং রুম। চার চেয়ারের ছোট একটা ডাইনিং টেবিল দেখা যাচ্ছে লাইটারের মৃদু আলোয়। একপাশে রেফ্রিজারেটর। পুরো বাসায় আসবাবপত্র তেমন নেই। তারপর ছোট টুলের মতো কিছুতে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো সোহেলের। কোনমতে সামলাল নিজেকে।

     ডানদিকে একটা বেডরুম। বাগদাদি ওদের বাইরে থাকতে বলে রুমে ঢুকল। বেরিয়ে এলো কিছুক্ষনের মধ্যে। বা দিকে সম্ভবত মাস্টার বেডরুম। এই রুমটাও খালি। তবে রুমের একপাশে স্লাইডিং দরজা দিয়ে আলাদা করা খোলা বারান্দার দিকে সবার চোখ।

     তাকিয়ে স্থির হয়ে গেছে সবাই। এরকম দৃশ্য দেখতে হবে কল্পনা করেনি।  

শামীম সাহেব বারান্দার রেলিঙের উপর দাঁড়িয়ে আছে, উঁচু বোর্ড থেকে সুইমিং পুলে ঝাঁপ দেয়ার মতো ভঙ্গিতে। তবে এক্ষেত্রে সে পানিতে পড়বে না। পড়বে বারো তলা নীচে শুকনো, খটখটে, পীচঢাকা পথে। এতো দূর পড়ার পর আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। সব থেতলে যাবে। ভদ্রলোকের এইভাবে আত্মহত্যা চেষ্টার কারন ঠিক পেছনেই দাঁড়ান। একজন নয়, দুজন।

     কিংবা একজন, বাকিজন কেবল ছায়া! ভাবল সোহেল।

     শামীম সাহেবের পেছনে জেসমিন দাঁড়িয়ে আছে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শামীম সাহেবের দিকে। হাত দিয়ে একটু ধাক্কা দিলেই নীচে পড়ে যাবে ভদ্রলোক। তবে জেসমিনের মনে হয় না সেরকম কোন উদ্দেশ্য আছে। শামীম সাহেব আর জেসমিন দুজন দুজনের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন দুজন দুটো কাঠের পুতুল। কিংবা মোমের মূর্তি। আর ছায়া! হ্যাঁ, এই মধ্যবয়স্ক মানুষটা সোহেলের পরিচিত! একটু আগেই তার পায়ের কাছে বসে পায়ের আঙুল খাচ্ছিল!

     যাকে কেবলই দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছিল, সে একদম বাস্তব। তবে ছায়া বাস্তব। কারন মধ্যবয়স্ক মানুষটাকে দেখা গেলেও তাকে ঠিক মানবীয় মনে হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে পুরো মানুষটাই ছায়ার তৈরি। যাকে ভেদ করে আলো-অন্ধকার সব অন্যপাশে চলে যাচ্ছে।

     জেসমিন আর মধ্যবয়স্ক মানুষটার পুরো মনোযোগ ছিল শামীম সাহেবের উপর। হঠাৎ বুঝতে পারল অতিথিদের আগমন। মধ্যবয়স্ক মানুষটা বড় বড় লাল চোখে তাকিয়েছে ওদের দিকে। ভয়ে কুকড়ে গেল সোহেল। আহমেদ করিম প্যান্টের পকেট থেকে তার পিস্তলটা বের করে আনলেন। তাক করে আছেন সামনের দিকে। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও বোঝা যাচ্ছে তিনি ঘামছেন, দরদর করে।

     বাগদাদি’কে শান্ত মনে হলো। সে তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে বেশ কিছু কাগজ বের করে আনল। তারপর উচ্চস্বরে আরবি উচ্চারন করতে লাগল। আমি পরে শুনেছিলাম আয়াতুল কুরসি পড়েছিল সে রাতে।

     মধ্যবয়স্ক লোকটার চেহারা আরো বিকৃত হয়ে গেল। বোঝাই যাচ্ছে রাগে গজগজ করছে, কিন্তু এগুচ্ছে না। একহাতে শক্ত করে জেসমিনের হাত ধরে আছে। বারান্দার রেলিং থেকে এক ফাঁকে নেমে এসেছে শামীম। তবে তার দিকে এখন মনোযোগ নেই কারো।

     বাগদাদি এগুচ্ছে। তার হাতে আরবি আয়াত লেখা কাগজ। মুখে আয়াতুল কুরসি।

বোঝাই যাচ্ছে, বাগদাদি’র এভাবে এগুনোটা পছন্দ করছে না মধ্যবয়স্ক লোকটা।  

     এরপরের দৃশ্যটার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। জেসমিনকে সাথে নিয়ে দ্রুত বারান্দার চিকন রেলিং-এ উঠে গেল মধ্যবয়স্ক লোকটা।

     তারপর ঝাঁপ দিল নিকষ অন্ধকারে।

***

ঐ রাতে শামীমকে সোহেল নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে এলো। তার রুমে রাখার ব্যবস্থা করল। বেচারা এতো শকড যে কথাও বলতে পারছে না। যতোটুকু বোঝা গেল, তাতে মনে হলো, ন’টার দিকে শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি দুজনকে হাসপাতালে রেখে বাসায় ফেরে শামীম। হাল্কা একটু খেয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর সে নিজেকে আবিষ্কার করে বারান্দার রেলিং-এ দাঁড়ানো অবস্থায়।

     নিজের উপর এতোটুকু নিয়ন্ত্রন ছিল না। ছোট একটা মেয়ে তাকে নিয়ন্ত্রন করছিল। যেকোন সময় ঝাঁপ দিত। ঠিক সেসময়ই সবাই ঢুকে পড়ে ফ্ল্যাটে। তাতে প্রানে বেঁচে গেছে বেচারা।

     বারোটার কাছাকাছি বাজে। বাগদাদি আর আহমেদ করিম একটু আগে চলে গেলেন। সোহেল চিন্তিত ছিল, তার অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর নীচে একজন পুরুষ আর বাচ্চা একটা মেয়ের লাশ পাওয়া নিয়ে। এতো রাতে নিশ্চয়ই অনেক হৈ চৈ হবে। পুলিশ আসবে। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। নীচে কোন লাশ পাওয়া যায় নি।

বাগদাদির বক্তব্যে বোঝা গেল, মধ্যবয়স্ক মানুষটা আসলে মানুষ ছিল না। ছিল জ্বিন, খারাপ জ্বিন। আর বাচ্চা মেয়েটা ছিল অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক জ্বিন। ঐ বারান্দা থেকে তারা ঝাঁপ দিয়েছে ঠিকই কিন্তু মাটিতে পড়ে নি।

ওদের কি হয়েছে তা জানে না সোহেল। জানতে চায়ও না। সে দুঃস্বপ্নের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে এটাই আসল কথা। নতুন টিমের প্রথম কেস হিসেবে আহমেদ করিম হয়তো কোন ফি নেবেন না, তবে ওদের দুজনকে ভালো কোথাও খাওয়াবে বলে মনে মনে ঠিক করল সোহেল। 

Shariful Hasan
sharif.h.lashkar@gmail.com
No Comments

Post A Comment

Shopping cart0
There are no products in the cart!
Continue shopping
0